পুন্ড্রনগরের রাজকুমার: শান্তা মারিয়া


কোন কোন মানুষ হারিয়ে যায়। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে, প্রতি বছর, সারা জীবনে কোন কোন মানুষ হারিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘তোমার চিন্তায় তোমার মা শয্যাশায়ী’ সংবাদ শুনে ফিরে আসে এবং ফের ঘর ছাড়ার পরিকল্পনা করে। কেউ কেউ সীমান্তের ওপারে চলে যায়। কেউ সংসার ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে আবার নতুন সংসার শুরু করে দ্বিতীয়বার অগ্নিদগ্ধ হওয়ার বাসনায়। এরা হারিয়ে যায় বটে। কিন্তু আমি এদের কথা বলছি না। এরা কারও কারও জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও অন্য কারও জীবনে ঠিকই ফিরে আসে। রাজনৈতিক কারণেও অনেক মানুষ হারিয়ে যায়। সেটা অন্য রকম। কেউ গুম হয়, কেউ গুম হওয়ার অভিনয় করে। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে হারানো আর ফিরে আসা বা না আসা দাবার চৌষট্টি ঘরের ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেসব হারানোর কথাও এখানে হচ্ছে না।

কিন্তু কোন কোন মানুষ সত্যিই হারিয়ে যায়। তারা কখন কিভাবে হারিয়ে গেল সেটা নিয়ে অনেক গবেষণা, অনেক থানা পুলিশ হয়, তাদের অনেকের আত্মীয় চায় তারা ফিরে না আসুক আর কেউ একজন চায় তার ফিরে আসা তবুও তারা ফিরে আসে না। যেমন ফিরে আসেননি অনীক রহমান।

অনীক রহমান নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবার থেকে ব্যাপক খোঁজ খবর হয়। তার স্ত্রীও দীর্ঘ কয়েক বছর অপেক্ষার পর আবার সংসার গড়েন। ছেলে মেয়েরাও বাবা নিখোঁজ কথাটি লিখতে লিখতে এবং বলতে বলতে এক সময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত কখন যেন মৃত লেখা শুরু করে স্বস্তি অনুভব করে।

অনীক রহমানের স্ত্রী নাবিলা ইসলাম বিয়ের পর হয়েছিলেন রহমান। পরে আবার হন নাবিলা আশরাফ। এইভাবে বারে বারে পদবী বদল করার কোন রকম ইচ্ছা তার ছিল না। এবং এটা করতে বাধ্য হওয়ায় তিনি অনীক রহমানের উপর আরেক দফা বিরক্ত হন।

প্রথমত, অনীক রহমানের উপর তিনি বিয়ের পর থেকেই বিরক্ত ছিলেন। বিরক্ত ছিলেন কারণ ধনী পিতার সন্তান হওয়া সত্বেও তাদের হানিমুনে যেতে হয়েছিল মহাস্থানগড়ে। বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক পছন্দে। প্রেম ট্রেম নাবিলার ধাতে ছিল না। প্রেম আবার কী? পছন্দ হবে, টাকা পয়সা থাকবে, লোকটা শাঁসালো হবে ব্যস। সাজানো গুছানো বাড়ি বা নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে আধুনিক ফার্নিচার থাকবে। কয়েক সেট গয়না শ্বশুরবাড়ি থেকে দিবে, স্বামীর একটা বড় চাকরি বা ব্যবসা থাকবে। আর কি দরকার? অনীক রহমানের বাবা হাবিবুর রহমান ছিলেন বৈষয়িক লোক। তিনি ঢাকায় একাধিক বাড়ি, জমাটি ব্যবসা সবই করেছেন। শ্বশুর হিসেবে হাবিবুর রহমানকে খুবই নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে নাবিলার। শাশুড়ি গত হয়েছিলেন নাবিলার বিয়ের তিনচার বছর আগে। এটা আরও সুবিধাজনক। একমাত্র ননদ থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। সেটাও মনোরম ঠেকেছিল নাবিলার কাছে। প্রবাসী ননদের স্ট্যাটাসটা ভালো, আবার ননদ কাছে থাকার ঝামেলাও নেই। বিদেশ থেকে ননদ সম্পত্তির ভাগ নিতে আসবে না, এটা তো জানা কথা। নাবিলার বাবাও সম্বন্ধটা পছন্দ করেছিলেন মনেপ্রাণে। বিয়ের আগে অনীক রহমানকে মাত্র একবার দেখেছিলেন নাবিলার পরিবার। সকলেরই ছেলেটিকে পছন্দ হয়েছিল। সে আমেরিকার ভার্জিনিয়া ইউনিভারসিটি থেকে পিএইচডি করে সবে দেশে ফিরেছে। এ জায়গাটাতে একটু খটকা লেগেছিল নাবিলার। আমেরিকা থেকে আবার কেউ দেশে ফিরে আসে নাকি? সবাইতো বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে যায়। এ লোকটা বাংলাদেশে ফিরে এলো কেন? ওখানে কোন ক্রাইম করেনি তো?

তখনও অনীকের পিএইচডির বিষয়টা শোনেননি তিনি। পরে শুনে বিরক্তি আরেক দফা বেড়েছিল। অনীকের গবেষণার বিষয়ক ছিল প্রাচীন পুন্ড্রনগরের সামাজিক রীতি। এইটা একটা বিষয় হলো? লোকে আমেরিকা গিয়ে এমবিয়ে অথবা কম্পিউটার সায়েন্স পড়বে তবে না। বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণার আছেটা কি? সেটা তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই করা যায়। সেজন্য ভার্জিনিয়া ইউনিভারসিটি লাগে! আমেরিকায় বসে বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণা! শুনলে বান্দরেও হাসবে। দেশে ফেরার পর অনীক কোন চাকরিতে ঢোকেননি। না বাবার প্রতিষ্ঠানে, না কোন ইউনিভারসিটিতে। নাবিলা সেটা নিয়ে চিন্তা করেননি। কারণ শ্বশুরের যা আছে তা একমাত্র পুত্র অনীক রহমান দুই তিন জেনারেশন বসে খেয়েও শেষ করতে পারবেন না। অনীকের চেহারা ভালো লেগেছিল নাবিলার। মধ্যম উচ্চতার কিন্তু খুবই সুগঠিত দেহ। গায়ের রঙে পলিমাটির আভাস। বড় বড় কালো চোখের দৃষ্টিটা ছিল ঘোরলাগা মানুষের মতন। অনীককে দেখলে সকলেরই মনে হতো ঠিক এই কম্পিউটার আর ইন্টারনেট যুগের মানুষ সে নয়। যেন অনেক আগের পৃথিবীর কোন রাজপ্রাসাদে তার জন্ম। বেহুলা-লখিন্দরকে নিয়ে আজকাল কোন সিনেমা হলে সেখানে অনীককে মানাতো খুব।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি তারা বিয়ে করেন। সেসময় হানিমুনে যাবার রীতি ছিল সিংগাপুর বা ব্যাংকক। মধ্যবিত্তরা অন্ততপক্ষে কক্সবাজার যায়। কিন্তু অনীকের সবকিছুই অদ্ভুত। সে নাবিলাকে নিয়ে গেল বগুড়ায়। মহাস্থানগড়ে হানিমুনে যাচ্ছে শুনে নাবিলার রাগে দুঃখে প্রায় কান্না এসে গিয়েছিল। বন্ধুবান্ধবের কাছে মুখ দেখানোই ভার। প্রেস্টিজ বলতে আর কিছু রইল না।  তবু ভালো যে বগুড়ার সার্কিট হাউজে উঠেছিল তারা। অন্তত আধুনিক সুযোগ সুবিধা সেখানে আছে।  মহাস্থানগড়ে গিয়ে সারাক্ষণ কতগুলো মাটির ঢিবির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা আর অনীকের লেকচার শোনা। ইতিহাস ছিল স্কুলে নাবিলার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়। অনীকের কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতেন তিনি।

অনীক কিন্তু একঘেয়ে সুরে কিসব প্রাচীন নগরীর কথা বলে যেতেন। নাবিলা শুনছে কি শুনছে না সে খেয়ালও করতেন না। তার চোখের দৃষ্টিতে সেই ঘোর আরও ঘনীভূত হচ্ছিল দিনের পর দিন।

বগুড়া থেকে গুলশানের বাড়িতে ফিরেও অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি। অনীক ডুবে থাকতেন মোটা মোটা বইতে। বিভিন্ন দেশ থেকে পোস্টে বই আনাতেন। কত খরচ পড়তো কে জানে। হাবিবুর রহমানও একমাত্র পুত্রের সঙ্গে তেমন কথাবার্তা চালাতে পারতেন না। দুজন দুই গ্রহের বাসিন্দা। তবে ছেলেকে ভালোবাসতেন তিনি। জগত সংসার সম্পর্কে উদাসীন এই ছেলেটাকে দেখলে অজান্তে মনটা স্নেহে ভিজে উঠতো তার। হাবিবুর রহমানের সত্যিকারের যোগাযোগ ছিল পুত্রবধূর সঙ্গে। মেয়েটি বাস্তব জ্ঞানবুদ্ধি রাখে। অনীকের মতো স্বপনচারিনী নয় মোটেই। ব্যবসার কথা, টাকা পয়সা, সম্পত্তির দেখভাল, জাগতিক যাবতীয় হিসেব নিকেষের কথা হতো ওর সঙ্গেই। ছেলেকে তিনি টাকা পয়সা দিতে কোনদিন কার্পন্য করেননি। তবু ছেলেটা আপন হতে পারলো না। অনীক যেন অন্য কারও সন্তান। ভুলে তার ঘরে এসে পড়েছে।

বিয়ের তিন বছরের মাথায় জমজ সন্তানের জন্ম দিয়ে বংশ রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালন করাতে শ্বশুর আরও খুশি হয়ে নাবিলাকে এক সেট হীরার গয়না উপহার দেন। যমজ এক ছেলে, এক মেয়ে। অনীক তাদের নাম রাখতে চেয়েছিলেন আম্রপালি আর বিজয় সিংহ। নাবিলা এসব উদ্ভট খেয়ালে রাজি হননি। মেয়ের নাম আম আর ছেলের নাম সিংহ? এত পাগলও মানুষ হয়? সুমাইয়া আর রুবায়েতের জীবনে তাদের খাপছাড়া বাপের কোন প্রভাব না পড়ে সে বিষয়ে বরং তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। শ্বশুরও একমত ছিলেন। ছেলে মেয়েরা প্লে গ্রুপে যাবার উপযুক্ত হতেই শ্বশুরের অফিসে বসা শুরু করেছিলেন নাবিলা। কাউকে না কাউকে তো ব্যবসার হাল ধরতে হবে।

বিয়ের সাত বছর পর নাবিলা একটা বিষয় খেয়াল করেন। একদিন অফিস থেকে সন্ধ্যার পর ফিরেছেন তিনি। সাধারণত অফিস থেকে ঢাকা ক্লাব হয়ে আসেন, কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার আশরাফ সাহেবও তার সঙ্গে থাকেন। সেদিন শরীরটা ভালো লাগছিল না। বাড়িতে ঢুকে শুনলেন শ্বশুর কোথায় বেরিয়েছেন। ছেলে মেয়েরা বাড়ির নিচতলাতে টিভি গেম খেলছিল। দোতলাটা যথারীতি অন্ধকার। এককোণে অনীকের পড়ার ঘরে শুধু আলো জ্বলছিল। অনেক রাতই অনীক স্বামী স্ত্রীর বিশাল বেডরুমে আসেন না। পড়ার ঘরেই রাতটা কাটিয়ে দেন। নাবিলা সেসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। কিন্তু সেদিন অনীকের ঘরের পাশ দিয়ে নিজের বেডরুমে যাবার সময় ওর ঘরে নারীকণ্ঠ শুনতে পেলেন যেন। নাবিলা কিছু না ভেবেই অনীকের পড়ার ঘরে ঢুকলেন দুতিন বছর পর। অনীক নিবিষ্ট মনে পড়ছেন। তার ঘরে প্রবেশের শব্দটুকু শুনতে পাননি। ঘরে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। কিসের যেন একটা গন্ধ। নাবিলা ঠিক ধরতে পারলেন না গন্ধটা কিসের। ধূপের ধোঁয়ার সঙ্গে মোমবাতির গন্ধ মেশানো একটা পুরনো পুরনো গন্ধ। একটু যেন সুগন্ধও মিশে আছে। কিন্তু আধুনিক পারফিউমের নয়, কামিনী ফুলের ঘ্রাণের মতো। এই অদ্ভুত গন্ধটা কোথা থেকে আসছে বুঝতে না পেরে নাবিলা হেঁটে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গেলেন। অ্যাটাচড বাথরুমেও উঁকি দিলেন। কেউ নেই। তবে গন্ধটা ছড়িয়ে আছে ঘরের সব জায়গায়। অনীককে জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুমি কি রেডিও শুনছ নাকি?’ অনীক ঘুমভাঙা চোখ নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন কিন্তু কোন জবাব দিলেন না। অনীকের অবশ্য একটা মোবাইল ফোন ছিল। ঢাকায় মোবাইল ফোন তখন সদ্য চালু হয়েছে। স্ট্যাটাস সিম্বল। ছেলের জন্মদিনে হাবিবুর রহমান একটা ঢাউস মোবাইল সেট উপহার দিয়েছেন। তবে অনীক সেটা খুব একটা ব্যবহার করতেন না। কার সঙ্গেই বা কথা বলবেন? তার তেমন বন্ধুবান্ধব তো ছিল না। তবু নাবিলার মনে হলো তিনি নিশ্চয়ই ভুল শোনেননি। অনীক হয়তো মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলছিল, দূর থেকে সেটাই মেয়েদের কণ্ঠের মতো মনে হয়েছে।

এর এক সপ্তাহ পরেই একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল নাবিলার। তিনি আলো জ্বেলে দেখলেন রাত তিনটা। তার এমনিতে কখনও রাতে ঘুম ভাঙে না। ঘুমের আগে সামান্য একটু বিয়ার পানের অভ্যাস আছে তার। এতে ঘুমটা খুব সলিড হয়। কিন্তু সেদিন বোকার মতো কয়েক কাপ কফি খেয়েছিলেন। হয়তো একারণেই ঘুমটা চটেছে। অনীক বেডরুমে নেই। সেটা কোন ঘটনা নয়। কিন্তু অনীকের ঘরে মৃদুকণ্ঠে কে যেন কথা বলছে। একটি পুরুষ অন্যটি নারী কণ্ঠ। পুরুষ কণ্ঠটি অনীকের তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মেয়েটি কে? নাবিলা খুব নিঃশব্দ পায়ে ওই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরের দরজা ভেজানো। মৃদু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। নাহ, অনীক একাই বই পড়ছেন। ঘরে আর কেউ নেই। সেদিনের সেই গন্ধটা আজকেও রয়েছে। শুধু রয়েছে নয়, আরও যেন জোরালো হয়েছে। একেবারে ঘর ভুরভুর করছে সেই গন্ধে। নাবিলা ভিতরে এগিয়ে যেতে আজকে অনীক চোখ তুলে তাকালেন। একটু হাসারও চেষ্টা করলেন।

‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে’? সরাসরি প্রশ্ন করলেন নাবিলা।

‘কথা? কার সঙ্গে? কি বলছো?’ একটু অবাক হওয়ার ভান করলেন অনীক। মিথ্যা কথা বলতে একেবারে অনভ্যস্ত অনীকের দিকে তাকিয়েই ভানটা ধরে ফেললেন নাবিলা। বুঝলেন অনীক কিছু একটা লুকাচ্ছে। কিন্তু সেটা কি তা ধরতে পারলেন না। অনীকের সামনের খোলা বইটার দিকে তাকালেন কি করবেন ভেবে না পেয়ে। অনীক মোটা একটা বই পড়ছিলেন। ইংরেজি। যে পাতাটা খোলা ছিল তাতে কিছু ছবি চোখে পড়লো তার।

-‘কি পড়ছো এত মন দিয়ে?’

কথা ঘোরানোর সুযোগ পেয়ে যেন খুশি হয়ে উঠলেন অনীক। ছবিগুলো দেখিয়ে বললেন,

-‘দ্যাখো। খুব ইন্টারেস্টিং। এখানে একজন আর্কিওলজিস্ট মহেঞ্জদারো আর পুন্ড্রবর্ধনের কিছু শিলালিপির মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছে। তার মানেটা বুঝতে পারছো তো?’ নাবিলা বুঝলেন না। বুঝতে চাইলেনও না। নেহাত কথা বলার জন্যই প্রশ্নটা করেছিলেন। কিন্তু অনীক খুব উৎসাহ নিয়ে বলে চললেন, ‘এই যে দ্যাখো। পোড়া মাটির ফলক। ছবিগুলোর মধ্যে মিলটা কেমন স্পষ্ট দেখো।’

নাবিলা একটু কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বইয়ের পাতাটায় চোখ রাখলেন। পোড়ামাটির ফলকের একটা এনচার্লজড ছবি। আলিঙ্গনাবদ্ধ একজোড়া নারী ও পুরুষ। নারীটির ছবি নয়, নাবিলার দৃষ্টি কেড়ে নিল পুরুষটি। পুরুষটির পরনে চাদরের মতো একটা পোশাক। দেহের উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত। নারীটিরও তাই। কিন্তু পোশাক কোন বিষয় নয়। বিষয় হলো পুরুষটির চেহারা। একদিক ফিরে আছে। সেই একপাশ থেকে তাকে দেখতে হুবহু অনীকের মতো লাগছে। মিলটা এত প্রকট ও পরিষ্কার যে নাবিলা অনীকের দিকে তাকিয়ে আবার ছবির দিকে তাকালেন। হ্যা কোন ভুল নেই, একদম অনীকেরই ছবি এটি।

-‘তোমার ছবি এখানে কেন?’ প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল তার।

-‘আমার ছবি? যাহ এটা তো আড়াই হাজার বছর আগের ছবি।’ ধরা গলায় বললেন অনীক। যেন কথাটিকে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেও তিনিও জানেন এটা তারই ছবি। নাবিলা এবার আরও মনোযোগ দিয়ে ছবিটা আর অনীককে দেখলেন, মিলিয়ে নিলেন যেন। কে গড়েছে এই মাটির ফলক? কোন ক্ষণজন্মা শিল্পীর সাধ্য আছে এমন নিখুঁত মুখাবয়ব গড়ে তোলার। আড়াই হাজার বছর আগের এই মেয়েটিই বা কে? ওর প্রেয়সী নিশ্চয়ই। নাবিলা বুকের ভিতর ঈর্ষার মৃদু দহন অনুভব করলেন। কেন ঈর্ষা? তিনি কি অনীককে এতটা ভালো কখনও বেসেছেন যে তাকে অন্য নারীর আলিঙ্গনে দেখলে তার ঈর্ষা হবে?এই যুগলের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এরা পরষ্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসে। গত সাত বছরে, স্ত্রী হয়ে, সন্তানের মা হয়েও তো এই পুরুষটির এত কাছে এত নিবিড়তায় তিনি কোনদিন প্রবেশাধিকার পাননি। নাবিলার অদম্য ইচ্ছা হলো ওই নারীটির মতো অনীককে জড়িয়ে ধরে এই পুরুষের উপর তার একচ্ছত্র মালিকানা জাহির করতে। কিন্তু পারলেন না। সেটা অতি নাটকীয় মনে হবে। তাদের সাত বছরের দাম্পত্যে কবে যেন সব নাটকীয়তা মুছে গিয়ে অভ্যস্ত দৈনন্দিন তার শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে। নাবিলা শুধু অনীকের হাতের উপর হাতটা রাখলেন। হাতটা ঠাণ্ডা। বরফের মতো ঠাণ্ডা নয়। পুরনো মার্বেল পাথরের মতো একটা শীতলতা যেটা মনের ভিতরেও কেমন অস্বস্তিকর নীরবতা নিয়ে আসে।

– ‘অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাতে এসো’। মৃদু স্বরে একথাটিই শুধু বলতে পারলেন তিনি।

-‘তুমি যাও, আমি আসছি’। না সে রাতে আর যৌথ শয়নকক্ষে প্রবেশ করেননি অনীক। তার পরের দিনও না। সেই রাত্রিই ছিল নাবিলার জীবনে অনীককে একান্তে পাওয়ার শেষ রাত্রি।

অনীক যেদিন নিখোঁজ হন সেদিন বিকেলেই ঘরে ফিরেছিলেন নাবিলা। নিজের বেডরুমে যাবার পথে অনীকের ঘরে একঝলক দেখেছিলেন তাকে বরাবরের মতো নিবিষ্ট মনে বই পড়তে। ঘরের পাশ দিয়ে যাবার পথে সেদিনও গন্ধটা পেয়েছিলেন। সেদিন গন্ধটা আরও তীব্র ছিল। ঘরের বাইরে থেকেও পাওয়া যাচ্ছিল।

নিজের বেডরুমে যাবার পর একবার সন্ধ্যার দিকে নিজস্ব ব্যালকনিতে বসেছিলেন। গন্ধটা অনীকের ঘর থেকে এ ঘর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছিল চূড়ান্ত তীব্রতায়। তাকে যেন অবশ করে দিচ্ছিল। নিচের বাগানের একটা অংশ চোখে পড়ছিল ব্যালকনি থেকে। বাগানের কামিনী ঝোঁপের পাশে একটি নারীকে দেখেছিলেন বলে মনে হয়েছিল। এলোখোঁপা করা শ্যামল রঙের এক নারী। পরনে সবুজ রঙের একটি কাপড় অদ্ভুত ভঙ্গীতে জড়ানো। শুধু এতটুকুই মনে করতে পারেন তিনি। কারণ সে শুধু এক পলের দেখা। এরপরই সন্ধ্যার অন্ধকারে কামিনী ঝোঁপের সঙ্গে যেন মিশে গিয়েছিল মেয়েটি। এমনকি মেয়েটিকে তিনি দেখেছিলেন, না সে ছিল শুধু তার কল্পনা সেকথাও হলফ করে বলতে পারেন না তিনি।

এর একটু পরেই বাড়ির কাজের ছেলে রেজাউল এসে বলেছিল,‘ম্যাডাম, স্যারকে কফি দিতে গিয়ে দেখলাম উনি ঘরে নাই। কই গেছেন?’ নাবিলা অনীকের ঘরে গিয়ে তাকে দেখতে পাননি। ঘর ভরে ছিল সেই গন্ধে। পরে আর কখনও এই গন্ধটা পাননি তিনি। আর কোনও দিনই অনীকের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। পুলিশ বাড়ির সকলকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেসময় বাড়ির নিচের তলাতে যারা ছিল তারা অনীককে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখেনি। দারোয়ান গেটে ছিল। এক মুহূর্তের জন্যও নাকি গেট ছেড়ে যায়নি সে।

দারোয়ানকে রিমান্ডে নেয়া সত্বেও বারে বারে বলেছিল, অনীক স্যারকে সে বাড়ির বাইরে যেতে দেখেনি। নিজের ঘরের ভিতর থেকে একজন মানুষ বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে একথা পুলিশ বিশ্বাস না করলেও অনীক কোথায় গেছেন সে তথ্য তারা জানাতে পারেনি সারাদেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও। ছেলের সন্ধান চেয়ে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেও লাভ হয়নি হাবিবুর রহমানের। পুত্রশোক নিয়তিতে ছিল এ কথা তাকে মৃত্যুর আগে স্বীকার করতে হয়েছে।

কয়েক বছর পর ম্যানেজার আশরাফকে বিয়ে করেন নাবিলা। অনীক নিখোঁজ হন ২০০২ সালে। এর পর থেকে তাকে আর কখনও কোথাও দেখা যায়নি। তবে নাবিলা এখনও মাঝে মাঝে ভাবেন অনীক রহমান পুন্ড্রনগর থেকে ফিরে আসতেও পারেন সময়ের গণ্ডিবিহীন কোন অন্য রাত্রিতে।