গুচ্ছ কবিতা: রেজাউদ্দিন স্টালিন


 

কপোতাক্ষ

ব্রহ্মপুত্র যখন কপোতাক্ষের মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকালো
হাজার বছরের শীলিভূত স্মৃতিস্তম্ভরা
রক্তাধিকারের বেগে জেগে উঠলো আমার শিরাস্রোতে
কিন্তু দেখলাম গর্জমান ফেনায়িত সেই স্মৃতিদৃষ্টি এখন ক্ষীণধারায় প্রবাহিত এবং চর দখলের দাগে দীর্ণ
সেই উপকূল

অবিকল কপোতাক্ষের মতো তার হাতে পলির পন্নগ আর কাঁধে ভাটির
ভৎর্সনা
কোনো কবি নেই যে অমিত্রাক্ষরের ঢলে ধুয়ে দেবে উচ্ছিষ্ট আবিল
মধুসূদন নেই যে আবার কপোতাক্ষের
তীর থেকে তাজ্য হবে
কোনো গীতিকা নেই যে ব্রহ্মপুত্রের নামে শ্লোক বিসর্জন দেবে

চতুর্দিকে জলহীন জীবিকার ব্যর্থ জৃম্ভণ আর জনপদজুড়ে ধুধু চরের চিৎকার
এমন পিতা রাজনারায়ণ নেই যে অভিমানে পুত্রকে পরিত্যাগ করে
মা জাহ্নবী নেই যার অশ্রুধারাতৈরি করে স্রোতের উজান
এই স্থির অপ্রতিরোধ্য গ্রাস আর শূন্যতার সমূহ শাসন
কপোতাক্ষের কালো চোখে চিতার চিহ্ন
ব্রহ্মপুত্রের বুকে উপুড় করা নিস্তব্ধ নৌকা-ধর্ষিতা গর্ভবতীর আত্মাণ্ডতি
দাঁড়গুলো দস্যুদের হাতে মাল্লাদের কর্তিত শিশ্নমূল

কোনো নারী নেই যার গর্ভের কোনো সন্তানের নাম কপোতাক্ষ হবে
যোগ্য যুবা নেই যার বীর্যধারা জন্ম দেবে ব্রহ্মপুত্র
আর কবি মধুসূদন পূণর্বার তীর থেকে
তাজ্য হয়ে
রচনা করবে তাঁর মহাবেদনার মেঘনাদবধ

 

এই রক্তস্রোত

রক্ত তরবারি চুইয়ে মাটিতে পড়ছে
চিবুক চুইয়ে পদতলে
বুক থেকে ব্রহ্মপুত্রে
মাটি থেকে নক্ষত্রে
লাল কালো নীরব ও নিষ্ঠুর
এই রক্তস্রোত
পদ্মা মেঘনা যমুনা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে
কতকাল কতযুগ বহমান রক্তস্রোত
প্লাবন ও পলিতে সমৃদ্ধ করবে সংগ্রাম

ঢেউয়ের চূড়ায় রক্ত-ফেনায় ফেনায়
এই রক্তস্রোত হৃদয়োত্থিত
দিন ও রাত্রির আবর্তন ভেঙে
পদক্ষেপের পেছনে পেছনে ধাবমান
দৃশ্যমান সবুজের করোটিতে রক্ত
সূর্যের আলোয়-শিরস্ত্রাণের চোখে
প্রাণী ও প্রকৃতির-রক্তাঞ্জলি

প্রতিরোধ স্বপ্নের পায়ে
কেউ তা জানে না
রক্তস্রোত থিতু হয়ে কোথায় দাঁড়াবে
কোন দেশে কোন কালে
কার কান্নাদগ্ধ করতলে
বর্ণমালায়

 

পরীক্ষা

নিজের ঘরের দরোজা কে বিক্রি করে
এবং পরিবর্তন করে ফুলের নাম
জন্মের আগে কে জানতো কোথায় তার বাড়ি
তার জন্য বরাদ্দ কোন হৃদয়

ভালোবাসা কৃপাভিক্ষা নয়
জীবনীগ্রন্থ নয় কাগজের উপর ছিটানো কোনো বর্ণমালা
তা’ এমন এক আলো যা দিনের বেলা
পথ দেখায়
ইতিহাস কেবল যুদ্ধের গল্প নয়
সংসারের উপাখ্যান নয় শুধু বিরহের

প্রেম এমন এক পরীক্ষা যা’ দিতে হয়
সারাজীবন ধরে

 

গুরুত্বের সংজ্ঞা

মানুষের অভ্যাস গুরুত্বপূর্ণকে খোঁজা
আসলে কাকে বলে গুরুত্বপূর্ণ
আজ যা গুরুত্ববহ- কাল তা’ নিষ্প্রাণ পতঙ্গ
আজ সবুজ পত্রালি-কাল আগুনের আহার
নিভন্ত লণ্ঠনের চেয়ে আলো মূল্যবান
ঠোঁটের চেয়ে চুম্বন
পথের চেয়ে গন্তব্য
স্বপ্নের চেয়ে আকাঙ্ক্ষা

বয়স ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় যৌবন
নদী হয়ে যায় বালির বন্ধু

একটা দিনের চেয়ে মুহূর্ত মূল্যবান
মন্দিরের চেয়ে প্রার্থনা
এবং অবশ্যই ইতিহাসের চেয়ে কবিতা

 

দায়

যে ঘরে দরোজা নেই
তার কি প্রয়োজন প্রহরীর
ভ্রুণ ধারণে অক্ষম যে গর্ভ
তার কেনো প্রসব যন্ত্রণা

উড়তেই হবে কেনো
যদি না থাকে ডানা তার
প্রবাহ পুঁতে রাখে যে স্রোত
তাকে স্রোতস্বিনী হতে
কে দিব্যি দেয়
মৃত্যুকে ভয় পায় যে জীবন
তাকে বাঁচতে বলে কে

ফলহীন বৃক্ষ সেতো অগ্নি উপাসক

শেকলের শব্দে যে অভিভূত তাকে
মুক্তি দেবে কে