যখনঘুম ভাঙে, নিজেকে অচেনা একটি ঘরে বিছানায় শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করে অবাক হয় নিয়ামত। ছোট একটি রুমে ১০০ ওয়াটের বালব জ্বলছে। ঘরে কোনো জানালা নেই। তবে বাতাস যাওয়া আসার জন্য ছাদের একপাশে নিচে ছোট্ট একটি ফাঁক রয়েছে। এই ঘরের মধ্যে থেকে এখন রাত না দিন বোঝার কোনো উপায় নেই। শুয়ে থেকেই চোখ ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে অবস্থা দেখার চেষ্টা করে সে। ঘরের মধ্যে মেয়েমানুষের কাপড় চোপড় ঝুলছে আলনায়, দড়িতেও ঝোলানো রয়েছে কিছু। সালোয়ার কামিজ, পেটিকোট, ব্রা, প্যান্টি।
বিছানার পাশে ছোট একটা প্লাস্টিকের র্যাকে লিপস্টিক, পাউডার, তেলের বোতল, মাথার চুলের ব্যান্ড ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ আলনায় চোখ পড়ে আবার। ওখানে নিজের প্যান্ট-সার্ট রাখা আছে বেশ যত্ন করে।
চমকে ওঠে নিয়ামত। নিজের প্রতি মনোযোগী হয়। খেয়াল করে তার পরনে লুঙ্গি, তবে সার্ট বা গেঞ্জি কিছু নেই ওপরে। তার মানে খালি গায়ে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে এতোক্ষণ ঘুমিয়েছিল সে। ঘরে একটা ফ্যান চলছে হালকাভাবে। ফ্যানের বাতাসটা খারাপ লাগছে না, আরাম বোধ করছে সে।
তার পরনে লুঙ্গি এলো কোত্থেকে? আর শরীর থেকে পরনের প্যান্ট সার্ট খুলে আলনায় রাখলো কে, কখন রাখলো, এখন সে কার ঘরে শুয়ে আছে, এখানে কখন, কীভাবে এলো সে- এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ামতকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলে। ঘরের বাইরে লোকজনের চলাচলের শব্দ হঠাৎ মাঝেমধ্যে পাওয়া গেলেও মেয়েমানুষের কণ্ঠ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এ জায়গাটা কোথায় বুঝে উঠতে পারছে না। ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছে সে। হঠাৎ কাশি পেল তার। বেশ কয়েকবার কাশলো সে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পানি খাওয়া দরকার।
রুস্তমের কথা মনে পড়লো। তার সঙ্গেই তো রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিল তার। এরপর আর কিছুই খেয়াল নেই।রুস্তম তাকে এই ঘরে রেখে কোথায় উধাও হয়ে গেছে। এখন সে কোথায় আছে, কে জানে। তার পকেটে থাকা মানিব্যাগের টাকার কথা মনে পড়তেই, বিচলিত হয়ে ওঠে নিয়ামত। তখনই ঘরের বাইরে থেকে খুট করে দরজা খোলার শব্দ পায় সে। তাতেই সচকিত হয়। তাহলে কি রুস্তম ফিরে এলো? প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় নিয়ামত।
নাহ, রুস্তম নয়, অপরিচিতি এক তরুণী ঘরে ঢুকছে। বাইশ তেইশ বছর বয়স হবে। দেখতে শুনতে খারাপ না হলেও বেশ সাজগোজ করে এসেছে। মোটামুটি গড়নের মেয়েটিকে হঠাৎ দেখলে খারাপ লাগে না। বরং এক ধরনের ভালোলাগা স্নিগ্ধ আবেশ ছড়িয়ে পড়ে মনে। অসুস্থ, দুর্বল শরীরে বিছানায় বসে অপরিচিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্থির হয়ে জানতে চায়, ‘আপনি কে, আমি এইখানে আসলাম কীভাবে, আমি যার সঙ্গে আইছি সে কোথায়? এইডা কোন জায়গা, আর একটা কথা -আমার গায়ের সার্ট প্যান্ট খুলছে কে, আর এই লুঙ্গি আইলো কোত্থেইকা?’
একসঙ্গে পরপর এতগুলো প্রশ্ন শুনে অদ্ভুত এক ভঙ্গি করে হাসে মেয়েটা। যেন সে নিয়ামতের অনেক দিনের চেনাজানা আপন কেউ। ততক্ষণে দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে আসে সে। তার হাতে বোতলভর্তি পানি, বনরুটি, বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিনের ব্যাগে কয়েকটি আপেল, মাল্টা, টুকরো করে কেটে আনা আনারস। সবগুলো জিনিস ঘরের মধ্যে গুছিয়ে রাখতে রাখতে মেয়েটি আবার অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে। তার হাসিটা আসলেই বেশ সুন্দর। যা দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়। খেয়াল করে নিয়ামত।
‘এই যে মিয়া ভাই, আপনের ঘুম ভাঙছে কবে? অনেকক্ষণ ধইরা বইসা রইছেন বুঝি?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে তরুণী।
তার প্রশ্নের জবাব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে না নিয়ামত।
‘আমি যা জানতে চাইছি, তার জবাব দিতেছেন না ক্যান, আপনে কে? রুস্তম আমারে এখানে রাইখ্যা কোথায় গেছে? আর শরীর থিকা প্যান্ট-সার্টসব খুলছে কে, আমার মানিব্যাগে টাকা পয়সা ছিলÑ
‘আপনের সব প্রশ্নের জবাব দিতেছি একটা একটা কইরা। তার আগে আপনে বনরুটি, বিস্কুট খান। তারপর আপেল কাইটা দিতেছি। আনারস আনছি কাইট্যা টুকরা কইরা। আপনের শরীর অনেক দুর্বল হইয়া গেছে। কী যে কঠিন জ্বর গেছে আপনের, শরীর পুইরা পুইরা গেছে। আমি আপনের মাথায় পানি ঢালছি অনেকবার, শরীরটা মুইছা দিছি গামছা ভিজাইয়া। এইভাবে জ্বরটা পড়ছে। তা না হইলে মাথায় রক্ত উইঠ্যা মইরা যাইতেন।আচ্ছা, আপনের এতো জ্বর বাড়লো কেমনে? ঐ যে করোনা না টরোনা, ওইডা তো হয় নাই আপনের আবার ? দেইখ্যেন। ঐ রোগ হইলে নাকি বাঁচে না কেউ, আবার যে তার কাছে যায়, তার সেবাযত,্ন চিকিৎসা করে তারেও নাকি ধরে করোনা। আমি তো আপনার সাথে আছি গত একটা দিন ধইরা, তা হইলে আমার কী হইবো ?
ভয় পাবার কৃত্রিম ভাব করে আবার হাসে মেয়েটা।
তার সহজ সরল আন্তরিক কথা বলার ভঙ্গি নিয়ামতের মনে মুগ্ধতা ছড়ায়। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে মেয়েটা তার মনের মধ্যে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে টের পায় নিয়ামত। যদিও সে তার নামধাম, পরিচয় কিছুই জানে না এখন পর্যন্ত। মেয়েটির কথায় বিছানায় পলিথিন ব্যাগে রাখা আনারসের কয়েক টুকরা মুখে দেয় নিয়ামত।মেয়েটি তার দিকে বনরুটি এগিয়ে দেয় ।
‘আপনার এখন এইগুলা খাইতে হইবো। আমি কাছের ওষুধের দোকান থিকা আপনের অসুখের কথা কইয়া কয়েকটা ওষুধ আনছি। সেইগুলো আপনের খাইতে হইবো। ওষুধের দোকানদার কইছে এই অসুখের জন্য এর চেয়ে ভালো ওষুধ নাকি নাই। আপনি খান, ভালো হইয়া যাইবেন।’
মেয়েটি তার চেনাজানা আপনজন কেউ নয়, আগে কোনো দিন দেখাও হয়নি। তারপরও মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা, অনেক আপনজন। যেভাবে ডাক্তারখানা থেকে বলে তার জন্য ওষুধ এনেছে। বনরুটি আর ফলমূল খাওয়ার পর আনা ওষুধপত্র দেখতে বলছে। তার সবকিছুতেই এক ধরনের মায়া মমতা ভাব জড়িয়ে আছে। বনরুটি ছিড়ে ছিড়ে মুখে দিচ্ছে নিয়ামত। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে বিছানায় এক পাশে বসা মেয়েটির মুখের দিকে।
‘শোনেন মিয়া ভাই, আমার নাম শাবনাজ। এইডা আমার ঘর। আপনারে এইখানে নিয়া আইছে রুস্তম শেখ। সে এখন ধান্ধাবাজিতে আছে। গেছে অন্য কারো লাইগ্যা মক্কেল ধইরা আনতে। তার কামই তো এইখানকার মাইয়াগো লাইগ্যা কাস্টমার ধইরা আনা। আপনারে যেমন আনছে আমার লাইগ্যা। আর আপনের গায়ের সব কাপড় চোপড় খুলছি আমি। এইখানে আমার কাছে যারা আসে, সব ব্যাডাই কাজকাম করনের আগে নিজের গায়ের কাপড় নিজেই খুইল্যা খাড়ায় আমার সামনে। আমার আর খুলতে হয় না। তয় আপনের গায়ের কাপড় খুলতে হইছে আমার। খারাপ কাজ করনের লাইগ্যা না। আপনের জীবন বাঁচানোর লাইগ্যা, যেভাবে শরীর জ্বরে পুইড়া যাইতেছিল, তখন যদি আপনের মাথায় পানি না ঢালতাম আর সারা শরীরে ভিজা গামছা দিয়া মুছাইয়া না দিতাম, তা হইলে ঘটনা অন্যরকম হইয়া যাইতো। আপনেরে জানে বাঁচান যাইতো না।
শোনেন, আপনে হয়তো মনে মনে অনেক রাগ করতেছেন আমার উপরে। আমি আপনের জান বাঁচাইতে এই কামডা করছি, বিশ্বাস করেন। আর এই জায়গাডা কোনখানে জানতে চাইছিলেন না। কইতেছি, এইডা হলো গোয়ালন্দের দৌলতদিয়ার বেশ্যাপাড়া। এইখানে আপনের মতো পুরুষ মানুষগুলো ক্যান আসে, সেইডা তো জানেন। আপনি কোন মতলবে আইছেন এইখানে, বুঝতে পারতেছি না। এতো অসুস্থ হইয়া আমার কাছে আগে তো কোনো পুরুষ মানুষ আসে নাই। অসুস্থ মানুষ এইখানে আইয়া কি করবো ? আমোদ ফুর্তি, কাজকাম, ইনজয় কিছুই তো করতে পারবো না। এইডা তো হাসপাতাল না। এইডা মাগিপাড়া। এইখানে সব বেশ্যা মাইয়ারা থাকে আপনাগো সেবার লাইগ্যা, বুঝছেন। এইখানে সবাই আসে ইনজয় করতে। আপনি ক্যান আইছেন বুঝতে পারতেছি না?
শাবনাজের মুখে একটানা এতোগুলো কথা শুনতে শুনতে চমকে ওঠে নিয়ামত। তার বাড়ি এই রাজবাড়ি জেলাতেই। দৌলতদিয়ার বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয়ের কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয় এটি। শুনেছে এশিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পতিতালয়গুলোর মধ্যে একটি। হাজার হাজার পতিতার বসবাস এখানে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে চলে আসছে এই দেহব্যবসার পসরা। বিভিন্নজনের কাছে এই পতিতাপল্লীর মেয়েদের নানা আচরণ, ধান্ধাবাজি, প্রতারণা, বেলেল্লাপনার নানা কাহিনী শুনে এসেছে এতোদিন। এখানে পা রাখার কথা জীবনে কখনও কল্পনা করেনি। দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লীতে যারা যাওয়া আসা করে তাদের অনেককে চেনে নিয়ামত। ঐ মানুষগুলোকে অপছন্দ করে সব সময় দূরে দূরে থাকতে চেয়েছে। যদি তারা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সেখানে নিয়ে যায়, তেমন ভাবনা থেকে এড়িয়ে চলতে চেয়েছেতাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নিজেই এখন দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লীর একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। গত প্রায় একদিন সময় পার হয়ে গেছে।
রুস্তম শেখকে চিনতে পারেনি সে। সহজ সরলভাবে তাকে কয়েকটি দিন নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিল শুধু। লোকটি যে বেশ্যাপাড়ার দালাল, টাকার বিনিময়ে কাস্টমার জোগাড় করে নিয়ে যাবার কাজ করে- এটা ধারণা করতে পারেনি নিয়ামত। রুস্তমের ফাঁদে পড়ে তাকে এখানকার এক বেশ্যা শাবনাজের ঘরে আশ্রয় নিতে হয়েছে- ভাবতেই ঘৃনায় সারা শরীর রি রি করে ওঠে। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হয় তার। হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে আসাটাই তার মস্ত বড় ভুল হয়েছে, উপলব্ধি করে। ওখান থেকে না পালালে আজ তাকে এখানে দৌলতদিয়ার বেশ্যা পাড়ায় শাবনাজের ঘরে ঠাই নিতে হতো না ।
মেয়েটি হয়তো ভাবছে অন্য সবার মতো সেও রুস্তমের হাত ধরে এখানে ফুর্তি করতে এসেছে। এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার এরকম ভাবাটাই স্বাভাবিক। এ জন্য মেয়েটিকে দোষ দেওয়া যায় না। এখন কী বলবে সে শাবনাজকে। এখানে আসার পুরো ইতিহাস আদ্যোপান্ত খুলে বলবে? করোনা সন্দেহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েও ভয়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে এসেছে সে । তার খোঁজে গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় পুলিশ গেছে। টেলিভিশনে খবরে তার নাম উল্লেখ করেছে। জেল পলাতক দাগি আসামির মতো অবস্থা তার এখন। নিজের বাড়ি কিংবা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যাওয়ারও সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই নিরাপদ একটি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিল রুস্তমকে। শেষমেষ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে মানুষটা। রুস্তম শেখকে মনে মনে অনেক গালি দিলেও এক সময় নিয়ামতের উপলব্ধি হলো, লোকটি এই ধান্ধা করে সংসার চালায়, বেশ্যাপাড়ায় কাস্টমার ধরে নিয়ে যায়, এর বিনিময়ে কমিশন যা পায় তাতেই পরিবারের অন্ন জোটে। রুস্তম তাকে তেমন একজন কাস্টমার হিসেবে শাবনাজের জন্য নিয়ে এসেছিল। হয়তো এর বিনিময়ে কিছু টাকা পেয়েছে সে।
শাবনাজ তার মানিব্যাগটি নিজের ট্রাংক থেকে বের করে বিছানায় রাখতে রাখতে বলে ,‘ব্যাগের টেকাগুলো গুইন্যা দেখেন। ঠিকঠাক মতো আছে কিনা দেখেন। রুস্তম আপনার টাকাগুলো ভাগাভাগি কইরা নিজে কিছু নিয়া আমারে কিছু নিতে কইছিল। আমি ধমক দিয়া তারে থামাইয়া দিছি। গরিব হইতে পারি, বেশ্যা হইতে পারি, সবার কাছে খারাপ মাইয়্যা হিসেবে পরিচিত হইতে পারি, চরিত্রহীন কইয়া আমাগো গালি দেয় সবাই। টাকা পয়সার দরকার নাই কার? আমারও দরকার। কিন্তু এইভাবে চুরি কইরা আপনের ব্যাগের টাকা নেওনের লোভ নাই আমার। আমি আমার শরীর বেইচ্যা যা পামু, তাতেই খুশি থাকতে চাই। কাজকাম কইরা যদি ভালো লাগে তা হইলে কেউ কেউ বখশিস দেয়, আমি কোনো সময় নিজের থিকা বখশিস চাইনা, যদি কেউ খুশি হইয়া দেয়, তা হইলে নেই, জোর কইরা বখশিস নেই না আমি।’ শাবনাজ হালকা সুরে কথাগুলো বলে তার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে হাসে।
নিজের মানিব্যাগটা ফিরে পেয়ে ভালো লাগে নিয়ামতের। ব্যাগের টাকাগুলো গুনে গুনে দেখে কয়েকবার। আশ্চর্য্য ব্যাপার, যা টাকা থাকার কথা তাই রয়েছে। একটি টাকাও কম নেই। বেশ্যা পাড়ার মেয়েরা সাধারণত কেমন হয়, তাদের স্বভাবচরিত্র, বেহায়া আচরণ, পুরুষ শিকারি মনোভাব, নির্লজ্জ ভাব, টাকা পয়সার প্রতি লোভ ইত্যাদি সব মিলিয়ে তার মনে তেমন একটি ছবি বাসা বেধে আছে। বিভিন্নজনের মুখে শোনা বেশ্যা পাড়ার খারাপ মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনতে শুনতে নিয়ামতের মনে তেমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে নিজের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়নি ।
আপনের জ্বরডা কি পড়লো? নাকি রইছে এখনও আগের মতো।দেখি, বলে শাবনাজ তার ডান হাতটা নিয়ামতের কপালে ছোয়ায়। তার শরীরের উত্তাপ অনুভবের চেষ্টা করে। মেয়েটির হাতের স্পর্শ এই মুহূর্তে অদ্ভুত এক শিহরণ ছড়িয়ে দেয় নিয়ামতের সারা শরীরে। তার ইচ্ছে করে শাবনাজের হাতটি ধরে নিজের দুহাতেরমধ্যে নিয়ে মুখোমুখি কাছাকছি বসে একান্তভাবে কথা বলতে। কিন্তু পরক্ষণেই বেশ্যা পাড়ার একজন মেয়ে হিসেবে তার পরিচয়টি মনে জাগতেই আবার পিছিয়ে আসে মনে মনে।
‘নাহ জ্বরডা নাই। আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানাই। আল্লাহ দয়া করছেন। আমি তো আপনের অবস্থা দেইখ্যা ঘাবড়াইয়া দেছিলাম। এখন তো যা শুনতেছি চারদিকে । করোনা রোগের ছড়াছড়ি। আপনের জ্বর দেইখ্যা ভয় পাইছিলাম। করোনা লইয়া আইলেন নাকি, চিন্তা করছিলাম, রুস্তম আবার কোন বিপদ আইন্যা ঢুকাইলো এইখানে, আমার ঘরে? আল্লাহ না করুক, আপনের সেই অসুখ হোক। যদি হইতো এইখানে চিকিৎসা করাইতাম কোনখানে নিয়া। শুনছি, যদি কারো এই রোগ হয় তার কাছে কেউ যাইতে চায় না। ভয়ে সবাই তার কাছ থিকা অনেক দূরে পলাইয়া যায়। হাসপাতালে গেলে ডাক্তারও চিকিৎসা না কইরা ভয়ে পালায়।
করোনা রোগির চিকিৎসা করাইতে চায়না তারা, আবার কোনো বাড়ি বা মহল্লায় এই রোগি পাওয়া গেলে পুরা বাড়ি এবং মহল্লা এমনকি পুরা গ্রাম পর্যন্ত ‘লকডাউন’ না কি জানি কইরা ফেলে? কেউ সেইখানে ঢুকতে পারেনা, আবার সেইখান থিকা বাইরও হইতে পারে না। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মুখ দেখাদেখি, কথা বলাও পর্যন্ত বন্ধ হইয়া যায়। আর একদম কাছাকাছি মানে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেলার পর্যন্ত প্রশ্নই আসেনা।
শাবনাজ সহজ সরল ভঙ্গিতে একটানা কথাগুলো বলে থামে, আসলে মেয়েটা এমনই। একবার কথা বলা শুরু করলে আর সহজে থামতে চায় না, বলতেই থাকে।
‘আচ্ছা যদি আমার করোনা রোগ পাওয়া যায়, পরীক্ষা কইরা যদি ধরা পড়ে আমার এই রোগ হইছে, তুমি ভয় পাইয়া পালাইবা নাতো?’ হাসতে হাসতে ঠাট্টাচ্ছলে কথাগুলো বলে নিয়ামত।
‘নাহ, আল্লাহ না করুক। আপনের করোনা হইবো ক্যান? আপনের সর্দ্দিজ্বরডা একটু বেশি গাঢ় হইছিল আর কি! তাই জ্বরডা বাড়ছিল। এই সময়ে এরকম হয় অনেকের। আপনেরও হইছে। আল্লাহর রহমতে আপনি সাইরা উঠতেছেন, আমি কইলাম, আপনের আর কিছু হইবোনা।
‘বাহ, তুমি তো একজন ডাক্তারের মতো কথা কইছো,’ কৌতুক করে বলে নিয়ামত।
‘করোনা হইলেই বা কি? আমি আপনের ফালাইয়া পালামু ক্যান? আপনের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য যেইখানে যাওয়া লাগে সেইখানে লইয়া যামু আপনেরে,’ শাবনাজের কণ্ঠে এক ধরনের আবেগ ঝরে পড়ে। সেই কণ্ঠে দৃঢ়তার প্রকাশও রয়েছে।
‘আমি তোমার কে? তুমি আমার জন্য এতো বড় রিস্ক নিবা ক্যান? এজন্য তোমারও তো বিপদ হইতে পারে। আমার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?’ একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করে নিয়ামত।
একসঙ্গে এতো প্রশ্নে কিছুটা চমকে ওঠে শাবনাজ। তাকে কিছুটা বিচলিত মনে হয়। নিয়ামতের প্রশ্নের জবাবে হঠাৎ কী বলবে বুঝে উঠতে সময় নেয়। এরপর বলে, ‘আমি আপনের কেউ না। আপনেও আমার কেউ না। কিন্তু আপনেও একজন মানুষ, আমিও একজন মানুষ। একজন মানুষ যদি আরেকজন মানুষের বিপদে আগাইয়া না আসে, তা হইলে কেমনে হইবো? আপনেরে সাহায্য করতে গিয়া যদি আমার বিপদও হয়, তারপরেও সাহায্য করা উচিত। আমি পিছাইয়া গেলে আপনারে বাঁচাইতে কে আইবো।’
তার কণ্ঠে অনেক আবেগের ছোঁয়া টের পায় নিয়ামত। অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে? হাসপাতালে করোনা সন্দেহে আইসোলেশন ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয়েছিল। তার রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতে নিয়েছিল হাসপাতালের ডাক্তার- নার্স। পরীক্ষার ফলাফল জানার আগেই ভয়ে-আতঙ্কে হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে সে।নিজের মোবাইল ফোনটাও হারিয়ে ফেলেছে। ওটা সাথে থাকলে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খোঁজখবর নিতে পারতো। শাবনাজের ঘরে এভাবে আর কতদিন থাকতে হয় কে জানে। মেয়েটি তার সব কাজকর্ম বন্ধ রেখেছে শুধু তার জন্য। সে তাকে নিয়েই পড়ে আছে গত দুটি দিন। একজন মুমুর্ষ, অসুস্থ মানুষকে সেবা শ্রশ্রুষা দিয়ে ওষুধ, পথ্য খাইয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। তার ঘরে কোনো খদ্দের আনতে পারছে না সে ।
গত বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের বিশেষ নির্দেশে দেশের সব পতিতালয়ের মতো এই দৌলতদিয়াও বাইরে থেকে খদ্দের ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খদ্দেরের অভাবে না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছে এখানকার সব মেয়ের। তবে লুকিয়ে আড়ালে আবডালে চলছে আবার শরীর বেচাকেনার ধান্ধা। এখানকার মেয়েরা বাইরে থেকে খদ্দের ধরে আনতে দালালদের কাজে লাগিয়েছে। লুকিয়ে সেই দালালরা হঠাৎ হঠাৎ খদ্দের ধরে আনছে এই ভয়ানক দুঃসময়ের মধ্যেও। রুস্তম যেমন শাবনাজের জন্য তাকে এনেছিল। সে এসে মেয়েটির লোকসান করে দিয়েছে। তার কারণে শাবনাজের আয় রোজগার একদম বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের গাটের টাকা পয়সা খরচ করে সে আবার তার জন্য ওষুধপথ্য, ফলমূল কিনে আনছে। এভাবে আর কতদিন চলবে ?
তার সার্ট প্যান্ট নিজের হাতে খুলেছে শাবনাজ। প্যান্টের পকেটে থাকা মানিব্যাগ থেকে একটি টাকাও সরায়নি। সব টাকা আগের মতোই আছে। রুস্তম তাকে মানিব্যাগে থাকা টাকাগুলো দুজনে মিলে ভাগাভাগি করে নিয়ে নিতে প্রস্তাব দিয়েছিল। অথচ সে তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। বেশ্যাপাড়ার একটি মেয়ে হলেও সে অন্য অনেকের মতো নয়। তার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ, সততা, মানবিকতা, নৈতিকতাবোধ বিদ্যমান বেশ ভালোভাবেই। সভ্য সমাজের ভদ্র শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের অনেকের মধ্যে তা নেই। আজকাল স্রেফ শারীরিক চাহিদা মেটাতে অবাধে ফস্টিনস্টি করে বেড়ায় শহর-গ্রামের ভদ্র শিক্ষিত অবস্থাপন্ন পরিবারের অনেক বউ,মেয়ে ।
স্বামী, সংসার, সন্তান ফেলে বাড়ির বাইরে পরপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয় আরো অর্থবিত্ত সম্পদের আশায়। তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, সততা, নৈতিকতার ছিটোফোঁটাও নেই। নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও দেরি করেনা। হয়তো দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপের কারণে শাবনাজকে এই ঘৃণ্য পেশা বেছে নিতে হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধগুলো এখনও অটুট রয়েছে। একজন অসুস্থ মুমূর্য অসহায় মানুষের বিপদে তাকে দূরে ঠেরে সরিয়ে দিতে পারেনি। একজন মানুষ হিসেবে তার পাশে দাঁড়িয়েছে, নিজের সাধ্যমতো সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিপদগ্রস্ত মানুষটিকে সাহায্য, সহযোগিতার জন্য নিজেকে নিবেদন করেছে। এ কাজ করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি হলেও তার ভ্রুক্ষেপ করছেনা।