গল্প: বাবার গন্ধ


 

নভেম্বর মাসে বিকেল বলে কিছু থাকে না। দুপুরের পরই যেন সন্ধ্যা নেমে আসে চারিদিকে।
অজয় খুব দ্রুত পা চালায়। হাট থেকে শেষবারের মতো মাছ-মোরগ কিনে বাড়িতে ফিরতে হবে তাকে। ওর বউ সুনয়না বলেছে, শেষদিন একটু ভালোমন্দ খেতে মন চাইছে ওর। একটা অনিশ্চিতের পথে যাত্রা করতে যাচ্ছে ওরা। কাল লতামারী ছেড়ে ওরা বেরিয়ে যাবে অনিশ্চিতের পথ। কোথায় কীভাবে কাটবে ওদের আগামী দিনগুলো ওরা জানে না। তবুও নিয়ম বলে একটা কথা, আইন যখন হয়েছে তখন তো তা মানতেই হবে।

গ্রামের হাট। অনেক মানুষ জড়ো হয় বিশাল বটগাছটাকে কেন্দ্র করে। চা’য়ের কয়েকটা স্থায়ী দোকান ছাড়া এখানে যারা বেচাবিক্রির জন্য আসে, সবাই অস্থায়ী। রাস্তার পাশে ছালা বিছিয়ে বসে যায় আনাজ-তরকারি-শাকসবজি বিক্রির জন্য। ইউনিয়ন কাউন্সিলের লোকেরা এসে টোল তোলে প্রতি হাটবারে। বেচাবিক্রি হোক-না-হোক টোল তাকে দিতেই হবে।
অজয় দু’টো মোরগ, বাজারে আসা নতুন আলু, ফুলকপি, পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ কেনে। ভালো-টাটকা মাছ খোঁজ করে সে। কিন্তু তেমন মাছ নেই। সুনয়নার অতৃপ্তিটা থেকেই যাবে বোধহয়।
রহিম ব্যাপারী সামনে পড়তে সালাম দিয়ে পাশে সরে দাঁড়ায় অজয়।

‘কে, অজয় না?’
‘জ্বি কাকা, আমি অজয়।’
সত্তর বছর পেরিয়ে যাওয়া রহিম ব্যাপারী চোখে একটু কম দেখেন আজকাল। তাছাড়া, হাটে মানুষজনের ভিড়ে সকলকে ঠিকমতো চেনাও যায় না। সব মুখগুলোকে কেমন যেন একরকম মনে হয়।
‘কী খবর তোমাদের? তোমার বাবা কেমন আছেন?’
‘ছিলাম তো ভালোই কাকা, কিন্তু কাল তো লতামারী ছেড়ে চলে যেতে হবে।’
রহিম ব্যাপারীর মুখটা যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায় কথাটা শুনে।
নাকের ওপর নেমে আসা গোল চশমাটা উপরে ঠেলতে ঠেলতে বলেন,
‘তোমরা সবাই কি যাচ্ছো? তোমার বাবাও?’
‘কী আর করবো কাকা, বাবাকে এখানে একলা রেখে আমরা যাই কী করে?’

রহিম ব্যাপারী অজয়ের কাঁধে হাত রেখে হাটের ভিড় ঠেলে ফাঁকা মতো জায়গাটায় এসে দাঁড়ান।
‘তোমরা না গেলে পারতে না বাবা?’
অজয় বৃদ্ধ মানুষটার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। ওখানে কি কয়েক ফোঁটা জল দেখলো ও?
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে রহিম ব্যাপারী আবার বলেন,
‘সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় এই এলাকার অনেক পরিবার পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে যায় ইন্ডিয়ায়। তোমার দাদা যায় নি। বলেছিলো, সবাই যায় যাক, আমার জন্মের মাটি ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।’
‘কাকা, আমরা তো ছিটের মানুষ। ছিটের মানুষ বলে সবাই কেমন যেন করুণার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকায়।’
‘কে তাকায় না তাকায় তা জানি না বাবা, কিন্তু তোমার বাবা আর আমি একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি, ঘুরে বেড়িয়েছি মাঠের পর মাঠ, একসঙ্গে খেলেছি, পুকুরে সাঁতার কেটেছি, খালে মাছ ধরেছি, আমাদের মধ্যে কখনো কোনো তফাৎ রাখিনি আমরা। এক থালায় তোমার বাবা আর আমি কতোদিন যে ভাত খেয়েছি তা তোমরা চিন্তাই করতে পারবে না। সেই তোমার বাবাও চলে যাবে!’

রহিম ব্যাপারীর কন্ঠটা এবার সত্যি সত্যি ভারী হয়ে আসে। পশ্চিম দিগন্তে ডুবতে থাকা সূর্যের লাল রঙগুলো কে যেন মাখিয়ে দেয় তার মুখে। এ রঙ কষ্টের না আনন্দের স্মৃতি জাগানিয়া তা বুঝতে পারে না অজয়।
উবু হয়ে সে রহিম ব্যাপারীর পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে উঠতে উঠতে বলে,
‘কাকা, আপনার কথা আমি বাবাকে বলবো। এখন আমি যাই?’
অজয়ের মাথার ওপর হাতটা রাখেন রহিম ব্যাপারী। অঘ্রাণের শুকনো বাতাসে খসখসে হয়ে যাওয়া হাতটা তার স্নেহের নরম প্রলেপ হয়ে ছড়িয়ে যায় অজয়ের মাথায়। অজয় আর অপেক্ষা করে না, তার বুকটাও যেন খাঁ-খাঁ করে ওঠে। উল্টোদিকে ঘুরে সে পা চালায় বাড়ির দিকে।

লতামারী খুব বড় ছিটমহল নয়। ত্রিশটি হিন্দু পরিবার বাস করে এখানে। মানুষ সাকুল্যে নব্বই জন। সবাই ওরা নাম লিখিয়েছে ট্রাভেল পাশের জন্য। ‘ছিটের মানুষ’ শব্দটা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে ওদের, এর থেকে মুক্তি পেতে চায় ওরা। কিন্তু শুধু দেশ আর পতাকা পরিবর্তন করলেই কি মুক্তি মিলবে? বাপ-দাদা-চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেলেই কি নতুন ঠিকানায় ওরা খুঁজে পাবে জীবনের আনন্দ, মুক্তির উদ্দাম বাতাস? মাথার ভেতর এরকম নানা প্রশ্ন আর তার উত্তর কয়েকমাস ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে অজয়ের। বাবাকে যদিও সে নানা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের কারণগুলো, কিন্তু সেই যুক্তি নিজের কাছেই মাঝে মাঝে মনে হয়েছে অসার। ওগুলোর কোনো সারবত্তা নেই, ও যা করছে তা একধরনের আবেগ থেকে করছে। আবেগ তো কখনও কোনো যুক্তি মানে না।

ঘরে বাতি জ্বালিয়েছে সুনয়না।
ভিটেয় উঠতেই চোখে পড়ে অজয়ের তার শূণ্য গোয়ালঘরটার দিকে। চারটি গাভি ছিলো। পরিচর্যা, খাবার দেয়া এবং দুধ দোয়ানোর সব কাজ সুনয়নাই একহাতে করতো। কৃষিজমির অভাবে দুধ বিক্রি করে আয়-রোজগারের একটা আলাদা ব্যবস্থা করেছিলো তার বউ। অজয় না করেনি। তার ট্রাক চালানোর আয় থেকে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে সুনয়নাকে ও দু’টো গাভি কিনে দিয়েছিলো। সেই দুই গাভি শেষ পর্যন্ত চারটেতে এসে দাঁড়িয়েছিলো। বলদ বিক্রি করেছিলো দু’টো। চারটে গাভি থেকে গড়ে প্রতিদিন দশ লিটার দুধ পেতো ওরা, দুধ কারবারীরা নগদ টাকায় রোজদিন এসে দুধ নিয়ে যেতো সুনয়নার কাছ থেকে।

ওরা চলে যাবে তাই গাভিগুলোকে একরকম পানির দরেই বিক্রি করে দিয়েছে অজয়। আজ চারদিন গোয়ালঘরটি ফাঁকা। অন্যদিন সন্ধ্যা হলেই সুনয়না ধূপ জ্বেলে দিতো গোয়ালঘরে। গাভিগুলোর শীত তাড়ানোর জন্য নাড়া বিছিয়ে দিতো মেঝেতে, গায়ে চড়িয়ে দিতো ছালার চাদর। কাশেম মোল্লা যখন গাভীগুলোকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো সুনয়নার চোখ বেয়ে অবিরল অশ্রুপাত হচ্ছিলো। নিজেকেও সংবরণ করতে পারেনি অজয়। এখন এই ভরসন্ধ্যায় শূন্য গোয়ালঘরটার দিকে চোখ পড়তেই ওর বুকটা হাহাকার করে ওঠে।

ছিটমহলে বেড়ে ওঠা অজয় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো বাংলাদেশে। কিন্তু ক্লাস সিক্সে উঠলে স্কুল কর্তৃপক্ষ ওকে আর ভর্তি করেনি। ছিটের মানুষদের ঠিকানা সরকারি খাতাপত্রে লেখা যায় না, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। সরকারি নির্দেশেনার বাইরে স্কুলগুলো যেতে পারে না, তাই স্কুল কর্তৃপক্ষও ছিটের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করেনা। আর ছিটের ভেতরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো স্কুল চালু না করায় অশিক্ষিতই থেকে যেতে হয় ওদের। অজয়ের লেখাপড়া ঐ পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত এসে ঠেকে গিয়েছিলো। অথচ অজয়ের বাবা সঞ্জয় নাথের চোখে ছিলো আকাশভরা স্বপ্ন।

অজয়ের বয়স তখন চৌদ্দ-পনেরো হবে। বাবা তার হাত ধরে নিয়ে এসেছিলো বগুড়া শহরে। তরুণ পরিবহন ব্যবসায়ী আবদুল হালিম বগুড়ায় থাকতেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় পরিচয় হয়েছিলো সঞ্জয় নাথের সাথে। যুদ্ধের নয়মাস কলকাতায় থাকতেনও কাছাকাছি জায়গায়।
স্বাধীনতার পর নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরে আসেন সবাই। আবদুল হালিমের পরিবহন ব্যবসায় দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে ওঠে। সঞ্জয় নাথ মাঝে মাঝে বগুড়ায় এলে দেখা করতেন হালিম সাহেবের সাথে।
ওঁর কাছে গেলে অজয়ের জন্য কিছু একটা তিনি করবেন এই আশায় একদিন কিশোর অজয়ের হাত ধরে হাজির হয়েছিলেন বাসায়।
আশাহত করেন নি হালিম সাহেব।

‘ছেলেকে আমার কাছে রেখে যান, আমি দেখবো।’
হালিম সাহেবের ত্রিশটা ট্রাক তখন বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অজয় হেলপার হিসেবে এক ট্রাক- ড্রাইভারের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলো। গাড়ির ছোটখাটো মেরামতের কাজ আস্তে আস্তে শিখে নিয়েছিলো ও। বয়স বিশ না পেরুতেই অজয় শক্ত করে ধরেছিলো ট্রাকের স্টিয়ারিং। হালিম সাহেব বগুড়ার একটা স্থায়ী ঠিকানা বসিয়ে দিয়েছিলেন অজয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্সে। ও যে ছিটের মানুষ কেউ জানতো না। দু’তিন মাস পর পর লুকিয়ে লতামারী গিয়ে বাবার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে আসতো। ছিটের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা অজয়ের বাংলাদেশি ঠিকানা ব্যবহার করে গাড়ি চালানোর বিষয়টা জানলেও না জানার ভান করতো।

বগুড়ার মেসের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো অজয়।
হালিম সাহেবকে পিতার মতো মান্য করতো। ট্রাক ড্রাইভারদের নষ্ট-ভ্রষ্ট জীবনের ভেতর অজয় ঢুকে গেলে প্রথম প্রথম হালিম সাহেব গালমন্দ করতেন অজয়কে। কিন্তু তিনিও একসময় উপলব্ধি করেন, যে পেশার সঙ্গে যে জীবনের ঢেউ খাপ খায়, সেই ঢেউ তিনি বন্ধ করবেন কীভাবে? তিনি আর কিছু বলেন নি, শুধু দেখতেন কাজ তার ঠিকমতো হচ্ছে কী না। এই সময় অজয় মদ-গাঁজা আর রঙমহলের জগতে পা ফেলে, কিন্তু যা-ই করুক না কেন, বাবার মান-সম্মানের দিকে লক্ষ্য রেখে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতেই হয়ে যেতো পাক্কা ড্রাইভার। গাড়ি চালানো ছাড়া আর কিছুই ভাবতো না।

এই সময় রঙমহলে সুনয়নার সাথে পরিচয় হয় তার। সদ্য বাগান থেকে তুলে আনা একটা স্নিগ্ধ গোলাপ যেন, গ্রামের অভাব অনটন সহ্য করতে না পেরে কাজের খোঁজে এসেছিলো বগুড়ায়।
তারপরই পা পিছলে ঢুকে যায় এই গহীন সুড়ঙ্গে।
মাসী মেয়েটিকে কোনো খদ্দেরের কাছে দিতে পারছিলো না তার কান্না আর একগুঁয়েমি স্বভাবের জন্য। অজয় মেয়েটিকে বশ করতে পারবে এই ভরসায় মাসী সুনয়নার ঘরে ঠেলে দেয় অজয়কে। মেয়েটিকে দেখেই একটা অদ্ভূত অনুভূতি দোল খেয়ে যায় অজয়ের ভেতর। ওর সব কথা খুঁটিয়ে শোনে। মেয়েটাও যেন আস্থা পায় অজয়ের নানা কথায়। তারপর মাসীর সঙ্গে লেনদেন চিরদিনের মতো চুকিয়ে দিয়ে অজয় রঙমহল থেকে বের করে আনে সুনয়নাকে।

তারপর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতিতে বিয়ে করে। হালিম সাহেব খুশিই হয়েছিলেন অজয়ের এই বিয়েতে, সংসারী হলে যদি ছেলেটা সুপথে আসে এই আশায়।
‘তোমাকে ছিটে যেতে হবে, আমার বাবা-মায়ের সাথে তুমি থাকবে। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে তোমাকে দেখে আসবো।’
অজয়ের এমন প্রস্তাবে খুশি হয়েছিলো সুনয়না। অজয় মনে মনে তখন ভেবেছিলো, ঈশ্বর এভাবেই মনে হয় বন্ধন গড়ে দেয় দু’টি মানুষের মধ্যে।
তারপর অজয় আর কোনোদিন রঙমহলমুখো হয়নি।

এসব আজ থেকে দশবছর আগের কথা।
একটা ছেলে হয়েছে ওদের। ঠিক যেন সুনয়নার মতো দেখতে হয়েছে ছেলেটা।
উঠোনে পা দিতেই অজয় দেখে ছেলেটা তার বাটিতে মুড়ি নিয়ে খাচ্ছে ঘরের মাটিলেপা বারান্দায়। রান্নাঘর থেকে সুনয়না এসে ওর হাত থেকে বাজারগুলো নেয়। গাঢ় হয়ে ওঠা চারপাশের অন্ধকারের ভেতরও ওর সামনে জ্বল্জ্বল্ করে ওঠে সুনয়নার মুখটা।
‘বাবা তো যেতে চায় না।’
‘কেন, কী বলে?’
‘বলে, বৌমা তোমরা যাও, আমি যাবো না। আমার জন্মভূমির মাটি ফেলে কী করে যাই, তোমরাই বলো?’
কোমর থেকে গামছাটা খুলে নিয়ে মুখটা মোছে অজয়।
ছিটের কারা কারা ভারত যেতে চায় এসব তালিকা করার জন্য ভারত সরকারের লোকজন যখন এসেছিলো সেদিন অনেক ভাবনায় পেয়ে বসেছিলো অজয়কে। বাবা আর ওরা তিনজন, চারজনের পরিবার ওদের। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাবার সাথে পরামর্শ করেছিলো ও।
‘বাবা, আপনি যাবেন তো?’
‘বুঝতে পারছি না অজয়।’
কেমন একটু অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তারপর নিজে থেকেই বলেছিলেন,
‘যেতেই হবে?’
‘না বাবা, তা না। দুই সরকারই বলছে, কেউ যদি থাকতে চায় থাকবে, সরকার কারো ওপর জোর করবে না।’
‘তুমি কী মনে করছো? যাবে?’
‘আপনার সিদ্ধান্তটাই তো আসল। আগে সেইটা আমার জানা দরকার।’
এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্তের জবাব যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না সঞ্জয় নাথ। তার শাদা হয়ে যাওয়া চুলগুলোর ভেতর হাত বোলাচ্ছিলেন তিনি। চোখ দু’টো যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিলো। তিনি বলেছিলেন,
‘এই শ্মশানেই তোমার মা’কে দাহ করেছি, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। আমিও চেয়েছিলাম এখানে আমারও দাহ হবে।’

তারপর গভীরভাবে একটা শ্বাস টেনে বলেছিলেন,
‘এই বাতাসে এখনও আমি তোমার মায়ের গভীর স্পর্শ পাই, যেন মনে হয় তোমার মায়ের অফুরন্ত মমতা আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। এই স্পর্শ, এই মমতা ছেড়ে আমি কি আর কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো?’
‘বাবা, ঠিক আছে আপনার কথা। কিন্তু আপনি তো জানেন, এটা এখন আর ভারত নয়, এটা বাংলাদেশ। আপনি যে মাটিতে জন্মেছেন সেই দেশ এখন আর নেই। আমি সুনয়না আর ছেলেকে নিয়ে চলে গেলে আপনাকে দেখবে কে? কে রেঁধে-বেড়ে খাওয়াবে আপনাকে? তাছাড়া, ছিটের প্রায় সবাই চলে যাচ্ছে।’
ছেলের কথার পিঠে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না সঞ্জয় নাথের। এসব কথা যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন,
‘তুমি যেটা ভালো মনে করো সেটাই করো। আমার কিছু বলার নেই।’

সরকারি লোকজনের কাছে ওদের চারজনের নামই দিয়েছিলো অজয়। আশেপাশের সবগুলো পরিবারই চলে যাবার খাতায় নাম লিখিয়েছে। কার্তিক, রাজেন্দ্র, সমরেশ, গোবিন্দদের কেউ থাকছে না বাংলাদেশে। বাবাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কার্তিককে সঙ্গে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলো অজয়। ঘুরেফিরে দেখে এসেছিলো কুচবিহারের দিনহাটা থানায় তাদের জন্য নির্মিত অস্থায়ী আবাসন এলাকা। এই অস্থায়ী আবাসন থেকে পরে তাদের কোথায় নেয়া হবে এমন প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেনি প্রশাসনের লোকগুলো, কিন্তু আশ্বাস দিয়েছিলো এই বলে যে, সরকার তাদের বাড়িঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে চাষবাসের জমিও দেবে বলে তারা শুনেছে। ছিট থেকে আসা লোকজনদের সবরকম সহযোগিতা ভারত সরকার করবে। ফিরে এসে অজয় বাবাকে সব বলেছিলো।

এখন সুনয়নার কাছে বাবার যেতে না চাওয়ার কথাটা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেলো অজয়। বারান্দায় রাখা কলস উপুড় করে পানি নিয়ে ঢক্ঢক্ করে খেলো সে। আসলে ওপারে যাবার দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে তার গলাও যেন কেমন জানি শুকিয়ে আসছে। এটা কি এই প্রকৃতি-পরিবেশ আর এতো বছর ধরে নিঃশ্বাস নেয়া বাতাস থেকে শিকড় উপড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্তের কারণে?
বাবাকে কী বলবে সে?
তবুও বাবার ঘরে ঢুকে বাবার পাশে বিছানায় বসে।
সেই ছোটবেলা থেকেই বাবার শরীরের একটা গন্ধ পায় ও। কেমন যেন মিষ্টি একটা গন্ধ। সারা ঘরে সেই গন্ধটা উড়ে বেড়ায়। গন্ধটা নাকে এসে ঢোকে।
হারিকেনের সলতেটা একটু বাড়িয়ে দেয় অজয়।
‘বাবা, আপনি নাকি যেতে চাচ্ছেন না?’
সঞ্জয় নাথ মনে হয় কোনো ঘোরের ভেতর ছিলেন। নাকি স্মৃতির জানালাগুলো খুলে ফিরে গিয়েছিলেন অতীতের দিনগুলোর দিকে? সেখান থেকে ফিরে আসতে তার সময় লাগে। অজয় সেটা বুঝতে পারে। তাই একটু অপেক্ষা করে সে আবার জানতে চায়,
‘বাবা, আপনি নাকি যেতে চাচ্ছেন না ভারতে?’

লতামারীতে অন্ধকার নেমেছে জাঁকিয়ে। অঘ্রাণের শীতল বাতাস উড়ে যাচ্ছে শরীর ছটুয়ে। কাল সকালে উপজেলা প্রশাসনের লোকজন ট্রাক-বাস নিয়ে আসবে এই ছিটে। যার যা সম্বল আছে সেটুকু গুছিয়ে নিয়েছে সবাই। এখন যেন কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও। কেমন একটা স্তব্ধতা, শুধু মাঝে মাঝে পাখপাখালির ডানা ঝাপটানো আর পোকামাকড়ের ডাকাডাকির শব্দ ছাড়া। এই শব্দহীন যাপনের ভেতর হঠাৎ কান্নার শব্দ উড়ে আসে বাতাসে। কানটা সজাগ করে অজয়।
সঞ্জয় নাথ হঠাৎ তড়বড়িয়ে বলে ওঠেন,
‘কে কাঁদে? কে কাঁদে?’
অজয় বোঝে, ওটা গোবিন্দর মায়ের কান্না। গোবিন্দ ওর একটা বোনের বিয়ে দিয়েছে রংপুরে। মেয়েটা স্বামীর সঙ্গে ওখানেই থাকে। মেয়েটাকে রেখে যেতে হচ্ছে বলে গোবিন্দর মা কয়েক সপ্তাহ ধরে সময়ে-অসময়ে চীৎকার করে কেঁদে উঠছে। গোবিন্দকে নাকি বলেছিলো,
‘মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া যায় না বাবা?’
‘কীভাবে নিবো মা? ও স্বামীর সঙ্গে থাকে। ওর স্বামী বাংলাদেশের মানুষ। স্বামী না গেলে আমার বোন কীভাবে যাবে মা?’
গোবিন্দ বলেছিলো, ওর মা সব বোঝে। বোঝার পরও তার যে আকুতি আর কান্না সেটা কোনো হিসেবের মধ্যে পড়ে না। মাকে নাকি ও রোজদিনই বোঝায়। কিন্তু মায়ের মন বলে কথা। কিছুই বুঝতে চায় না সবকিছু বোঝার পরও।
‘গোবিন্দর মা কাঁদছে বাবা।’
‘কেন কাঁদে?’
‘কাল আমরা ভারতে চলে যাবো সেজন্যেই হয়তো কাঁদছে।’
সঞ্জয় নাথ কিছু আর জিজ্ঞেস না করে চুপ করে থাকেন। অজয় তার প্রশ্নের কোনো জবাব পায় না বাবার কাছে।

সকাল হতে না হতেই লতামারীতে তোড়জোড় পড়ে যায়। ট্রাক-বাস কোনোদিন এই এলাকায় ঢোকেনি। এই প্রথম নিম গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় দু’টো বড় গাড়ি। প্রশাসনের লোকজন ট্রাভেল পাশ দেখে দেখে মালামালের লিস্ট করে ট্রাকে তোলে। আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন এসেছে ছিটের লোকদের বিদায় দিতে। কয়েকটা রাজনৈতিক দলের লোকজন ব্যানার নিয়ে এসেছে। ত্রিশটি পরিবারকে তুলে নিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে উপজেলা প্রশাসন আয়োজনের কোনো কমতি করেনি।

সুনয়না তাদের মালপত্র উঠোনে নামায়।
‘বাবাকে ডাকোনি?’
অজয় জানতে চায় সুনয়নার কাছে।
ছেলেটার জন্য নতুন জামা-প্যান্ট কিনেছিলো ও। ছেলেটা ঐ নতুন কাপড় পরে তৈরি হয়েছে। সে দৌড়ে ঢোকে দাদুর ঘরে।
‘দাদু, ওঠো-ওঠো, ও দাদু ওঠো।’
সাত বছরের তমালের ডাক কি বাবার কানে পৌঁছল না?
অন্যসময় তমালের হালকা ডাকেই ঘুম ভেঙে যায় সঞ্জয় নাথের।
অজয় বারান্দা পেরিয়ে বাবার ঘরে ঢোকে। বাবা কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে।
বাবার কপালে হাত রাখে অজয়।
‘বাবা, ওঠেন। যাবার সময় হলো তো!’
কিন্তু বাবার কপালটা ভীষণ ঠাণ্ডা মনে হয় তার। কাঁথাটা শরীর থেকে সরিয়ে গা’য়ে হাত দেয় সে। শীতল বরফের মতো শক্ত হয়ে আছে শরীর। অজয় চীৎকার দিয়ে ওঠে,
‘সুনয়না, সুনয়নারে, বাবা আর নাই।’
মুহূর্তে অজয়ের চীৎকার বিশাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে লতামারীতে। ঘরের দরোজা-জানালা আর চালা ছুঁয়ে তার কান্নার শব্দ আঘাত করে গাছপালায়, আর সেই আঘাতেই যেন সবকিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে।
প্রশাসনের লোকেরা ছুটে আসে।
অশ্রুসজল হয়ে ওঠে সবার চোখ।
নিয়মমতো শ্মশানে দাহ করা হয় সঞ্জয় নাথের দেহ। অজয় তার পোশাক পাল্টে নেয়, শ্মশান থেকে ঘটিতে তুলে নেয় বাবার ভস্ম গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দেয়ার জন্য।
সৎকার সমাপ্ত করে লতামারীর লোকেরা সীমান্তের দিকে যাবার জন্য বাসে উঠলে অজয় তার চারপাশের বাতাসে বাবার শরীরের সেই মিষ্টি গন্ধটা পায়। গন্ধটা পাখির মতো ঘুরপাক খেতে থাকে বাসের ভেতরে, কখনও উড়ে যায় বাসের জানালা দিয়ে, আবার ফিরে আসে।
সুনয়না কি টের পাচ্ছে কিছু?
হয়তো না। পেলে কিছু বলতোই।
সীমান্তে এসে ওদের বাস থামে। সবাই নামে। পারমিট দেখে দেখে ওদের এক এক করে ওপারে নিয়ে যায় সরকারি লোকজন। দুটো বাস দাঁড়িয়ে আছে ওদের দিনহাটা নিয়ে যাবার জন্য।
বাসে উঠতে যাবার সময় অজয় টের পায় বাবার সেই গন্ধটা আর পাচ্ছেনা সে। ওটা বোধহয় সীমান্তের ওপারেই থেকে গেছে। হয়তো ফিরে গেছে লতামারী, মায়ের কাছে।