তরতর করে পানি কেটে এগিয়ে চলেছে নৌকা, এ নদী, সে নদী। কখনও শান্ত নদী কখনও খরস্রোতা। কখনও স্রোতের টানে উল্টে যাবার মতো হয়। নৌকা আবার কখনও শান্ত নদীতে ঢিমে তালে চলে। এই-ই তো পক্ষীজানের জীবন। সেই ছেলেবেলা থেকে এই-ই তো দেখে আসছে পক্ষীজান। বুদ্ধি হবার পর থেকে নৌকাতেই নিজেকে দেখেছে। নৌকায় বসে বসে মাছ মেরে আর সেই মাছ বাজারে বিক্রি করেই চলেছে তাদের সংসার।
বাবা বলতেন পক্ষী আমার পয়মন্ত মেয়ে। ওর জন্ম হলো আর আমার সংসারে আয় উন্নতি হলো। সংসার বলতে তো ওই নৌকা। তবে আয় উন্নতি মানে মাছ বেঁচে দু’চারটি বাড়তি টাকা, একবেলা ভাল খাওন। ঈদে পার্বণে নতুন কাপড়। মানতা সম্প্রদায়ের লোকেরা এর বেশি চায়ও না, এর বেশি স্বপ্নও দেখেনা। তাদের চাওয়ার গণ্ডী সীমিত। ফলে একটু কিছু পেলেই বাড়তি আনন্দে উল্ল¬সিত হয়ে ওঠে। পক্ষীর মনে পড়ে ছেলেবেলায় বাবা একবার হাট থেকে তার জন্য লালডুরে শাড়ি এনেছিল। কী সুন্দর যে সে শাড়ির রং আর বুনন! সেই লক্ষী আর পক্ষীর প্রথম শাড়িপরা। এর আগে দু’বোন হাঁটুর উপরে তোলা খাটো ফ্রক পরতো। মা সেদিন পায়েস রেধেছিলেন, গুড়ের পায়েস। লক্ষী পক্ষী নতুন শাড়ী ধরলো এই উপলক্ষ্যে পায়েস। বাবার তখন আয় রোজগার ভালোই হতো। মা বাবা লক্ষী পক্ষী সবাই মিলে মাছ ধরতো তখন। সংসারের চার জোড়া হাত যদি একসঙ্গে মাছ ধরে তাহলে তো অনেক মাছ ওঠারই কথা। উঠতোও। আশে পাশের নৌকার জেলেরা হিংসা করতে ওদের। অতোটুকু মেয়ে দুটো অতোগুলো করে মাছ ধরে কী করে! তাদের পরিবারের বড়রা তো পারেনা। আর মাছেরা যেন পক্ষীর জালে ধরা দেয়ার জন্য মুখিয়েই থাকত। পাশের নৌকা থেকে কৈতরী বলত,
: আয় না পক্ষী আমাদের নৌকায়, দিন কয়েক থেকে যা। মা মনসার দিব্বি ফেরার সময় তোকে একখানা নতুন শাড়ি দেব। বেশি না, দিন কয়েক থেকে যাবি।
: কেন কেন তোমাদের নৌকায় থাকলে আমাকে শাড়ি দেবে, কেন শুধু শুধু?
: শুধু শুধু না, তুই আমাদের মাছ ধরে দিবি।
পক্ষীর খুব ইচ্ছে হয় দু’চারদিন কৈতরী মাসীর নৌকায় গিয়ে থাকতে, আস্ত একখানা নতুন শাড়ি হবে এই অবেলায়। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! গত দু¹া পূজায় বাবা একখানা নতুন শাড়ি দিয়েছিল। বছরের নয়মাসে সে শাড়ির এখন রং চটক কিছুই নেই।
ওর ইচ্ছে হয় লাফ দিয়ে এ নৌকা থেকে ও নৌকায় চলে যেতে। লক্ষণ আর তারামণিও ডাকে, আয় না, আয় না। কিন্তু হই হই করতে করতে ভেতর থেকে তেড়ে আসত মক্ষীজান।
: কী কাণ্ড আমার পয়মন্ত মেয়েটাকে ভাগিয়ে নেবার তাল। ওসব মতলব ছাড় কৈতরী। চেঁচিয়ে মা বলত কিন্তু রাগ নয়, মুখে থাকত হাসি। কৈতরীর মাসির সাথে মায়ের অনেক বন্ধুত্ব। আর বন্ধুত্ব হবে নাই বা কেন। এই জলজীবনে জেলে বহরের দু’চারজন মানুষ ছাড়া কথা বলার আছেই বা কে! তাছাড়া কৈতরী মাসি আর তাদের নৌকা প্রায়ই পাশাপাশি থাকে, একই নদীতে চলে। তাই মায়ের সাথে সুখ দুঃখের কথা হয়। কৈতরী মাসীর ছেলে লক্ষণের সাথেও খুব বন্ধুত্ব লক্ষী-পক্ষীর। যখন দুই নৌকা কাছাকাছি হয় তখন এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় লাফিয়ে যায় ওরা। তেঁতুলের বিচি দিয়ে গুটি খেলে, লুডুও খেলে মাঝে মধ্যে। বাজারের দোকান থেকে কান্নাকাটি করে এই লুডু কিনেছে পক্ষী। বাবার কিনে দেবার ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু পক্ষী সেই যে জিদ ধরলো তো ধরলোই। লুডু কিনে না দিলে সে খাবেনা, কিছুই করবেনা। বাবা প্রমাদ গুনলেন। পক্ষী তার পয়মন্ত মেয়ে। রাগ করে যদি একসন্ধ্যে মাছ না ধরে তাহলে মহা সর্বনাশ! বাবা তাই মেয়েকে বাড়তি খুশি করার জন্য খোট লুডু, সাপ লুডু দুটোই কিনে দিলেন। পক্ষীর সেদিন সেকী আনন্দ! সেই আনন্দেই সন্ধ্যেয় যেন সেদিন দ্বিগুণ মাছ ধরলো পক্ষী।
তা সে লুডুই এখন খেলে লক্ষী পক্ষী লক্ষণ তারামণি। কখনও এ নৌকায় কখনও ও নৌকায়। আর যখন ঢেউয়ের তালে নৌকা দুলে ওঠে তখন লুডুর গুটিগুলো ছিটকে পড়ে যায়। তা দেখে চারজনের সেকী খিলখিল হাসি! আবার যখন সাপে লক্ষণের গুটিটা গিলে ফেলে পক্ষী তখন আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। লক্ষী শুধু লাজুক হাসে। আস্তে করে পক্ষীর হাতে চিমটি দিয়ে বলে, অতো হাসিস না তো, দেখনা বেচারার মুখটা কেমন কালো হয়ে গেছে।
: ওরে বাপরে বাপ এখনই লক্ষণদার জন্য এতো দরদ! বিয়ের তো এখনও মেলা দেরি। মা বলেছে আরও তিন সন পরে তোদের বিয়ে হবে।
: চুপ কর, চুপ কর। তোর মুখে কিছুই আটকায় না।
লক্ষণদার মুখে সিঁদুরে মেঘ ধেয়ে আসে। ওদের কথা শুনে কৈতরী মাসি মুচকি হাসেন। এক নৌকার মধ্যে কথা লুকোবার জায়গা কোথায়। লক্ষী যেন মরমে মরে যায়।
দুই মায়ের কথা হয়েছিল লক্ষী আর লক্ষণের বিয়ে হবে। তাহলে তাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হবে। লক্ষণকে তাই মাঝে মাঝে ‘জামাইবাবু জামাইবাবু’ বলে ডাকতো পক্ষী। লক্ষণ কখনও রাগ করে ধেয়ে আসত কখনও মুখ নিচু করে থাকত। বড় লাজুক স্বভাব লক্ষণদার। দেখতেও যেন রাজকুমার। বড় কপাল করে জন্মেছিল লক্ষী। তাই লক্ষণদার মতো অমন স্বামী পেল। পক্ষীর ভাগ্যে যে কী আছে! কোন জেলে বহরের কোন কালাকুলা আর বদরাগী ছেলের সাথে তার বিয়ে হবে কে জানে! দীর্ঘশ্বাস পড়ে পক্ষীর!
কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাসই কী কাল হয়। দীর্ঘশ্বাস কী লক্ষীর গায়ে লেগে অসুস্থ করে ফেলে তাকে? কে জানে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে মারা যায় লক্ষী। ডাক্তার দেখানোর সময়ও দেয়নি। জড়ি-বুটি করা হয়েছিল। কোনো কাজ হয়নি। লক্ষীর লাশটা পানিতে ভাসিয়ে দিতে দিতে যখন বাবা মা কৈতরী মাসী আর লক্ষণদা হাউ মাউ করে কাঁদছিলো তখন বুক ফাটিয়ে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে পারেনি পক্ষী। কেন পারেনি সে তা জানেনা। কী এক অজানা অপরাধবোধ তাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল। আর সেই অপরাধবোধের তাড়নায় স্থবির হয়ে গিয়েছিল পক্ষী।
লক্ষী আখ্যান শেষ হয়ে গিয়েছিল। জীবন থমকে যাবার কথা ছিল। মার কান্নায় বাবার হা হুতাশে আকাশ বাতাস মাতাল হলেও মাত্র একটা দিন পার করে আবারও জাল ফেলেছিল নদীতে। এরই নাম জীবন! জাল না ফেললে মাছ উঠবে না, মাছ না উঠলে পেটে দানা পড়বেনা। যতোক্ষণ জীবন ততক্ষণই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম।
বড়ো দ্রুত স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছিল লক্ষী। শুধু লক্ষণদার চেহারায় মলিন ভাবটা মাঝে মাঝে দুলিয়ে দিত পক্ষীকে। মাঝে মাঝে বিদ্রোহীও করে তুলতো। ও কেন অতো মলিন হয়ে থাকে। যা হবার তাতো হয়েই গেছে। ও কেন আমাকে দেখেনা!
আজ অনেকদিন পর এ নৌকা থেকে ও নৌকায় যায় পক্ষী। হাতে লুডু। লক্ষণ আর তারামণি উদাস চোখে তাকায়।
: আয় লুডু খেলি।
: খেলবি কী করে। একজন যে কম।
তিনটি মন আকুলি বিকুলি করে ওঠে। তিনজোড়া চোখের কোণে পানি জড়ো হয়। পক্ষী বলে,
: অসুবিধা নেই। আমি লক্ষীর হয়েও খেলব। দুই ঘরে একাই খেলব।
বাস্তব জীবনেও লক্ষীর জায়গা নেয় পক্ষী। একদিন দুই মা শলা করে। যা হবার তাতো হয়েই গেছে। ভগবান চেয়েছিলেন এমনই। কিন্তু এখন অতীত ধরে বসে থাকলে তো হবে না। লক্ষী নেই, পক্ষী আছে। পক্ষীর সাথেই বিয়ে হয়ে যাক লক্ষণের।
সেদিন সেই পূর্ণিমার রাতে লক্ষণের ঘরে বউ হয়ে আসে পক্ষী। লক্ষণের বাবা একটা ভাল কাজ করেছিল। ছেলের রোজগার থেকে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে লক্ষণের জন্য একখানা নতুন নৌকার ব্যবস্থা করে ছিল। সেই নৌকাতেই বধূবরণ করেছিল কৈতরী। হাসতে হাসতে বলেছিল,
: সবসময় শুধু পক্ষীকে ডাকতাম আমাদের নৌকায় এসে দু’চারদিন থাকতে। ওর হাতে মাছ বেশি ওঠে। ভগবানের কী লীলা! পক্ষী চিরকালের জন্যই এসে গেল আমাদের নৌকায়।
গাল ভরে পান খাচ্ছিল কৈতরী। বিয়ের ভালমন্দ খাবার পর পান খেয়ে ঠোঁট না রাঙালে কী চলে! তার ঠোঁটের কোল বেয়ে নামছিল পানের লাল ধারা। মা মক্ষীজানেরও একই অবস্থা। এমন একটা দিনে কেউ একবারও তো ভুলে লক্ষীজানের কথা মনে করল না! জীবন কী এমনই! এতো সহজেই সবাই সব কিছু ভুলে যায়। গাঢ় কিছু, গভীর কিছু।
বিয়ের রাতে লক্ষণ যখন পক্ষীর মুখটা দু’হাতে তুলে ধরল তখন পক্ষীর দু’চোখের কোলে ধেয়ে এলো কান্নার সমুদ্র।
: এমন দিনে কাঁদিস কেনে?
: আমি জানি তুই দিদিকে ভালবাসতি। তাকেই বউ হিসেবে কল্পনা করেছিলি।
: তাতে কী! সেতো এখন নেই। তার কথা নিয়ে এই বিয়ের রাতে চোখের জল ফেলা কেন?
: এজন্যই যে আমি তোকে বলতে চাই, আমি তোর কাছে লক্ষী হয়েই থাকবো। এ কথাটা তোকে জানাতে চাই যে, আমি মনে মনে তোকে কামনা করতাম তাই বুঝি দিদি…
কথা শেষ করতে দেয়না লক্ষণ। পক্ষীকে কাছে টেনে নেয়।
: আমি লক্ষীকে পছন্দ করতাম ঠিকই। কিন্তু সে এখন নেই। যা আছে সেটাই বাস্তব। তুই কেন লক্ষী হয়ে থাকবি। তুই আমার পক্ষী, পক্ষী হয়েই থাকবি। পক্ষী, আমার পক্ষীরে…
দিনগুলো যেন রঙিন হয়ে উঠল। সারাদিন পরিশ্রম আর সারারাত আদর সোহাগ। লক্ষণ কিছুটা অলস প্রকৃতির। বেশি কাজ করতে চাইতোনা। বলত, আমরাতো মাত্র দুজন মানুষ। অতো পরিশ্রমেরই বা দরকার কী, অতো পয়সারই বা দরকার কী। পক্ষী লজ্জায় তাকে বলত পারতোনা, আজ দুজন আছি চিরটাকালতো দুজন থাকবোনা। তাছাড়া রাতে আদর সোহাগের যা বাড়াবাড়ি! দু’জন তিনজন হতে আর কদিন। বাস্তবেও সময় লাগেনি। বিয়ের একমাস যেতে না যেতেই অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে পক্ষী। কৈতরী বেেলছে পক্ষী আমার পয়মন্ত বউ। মাছ ধরাতে ও যেমন পয়মন্ত সন্তান ধারনেও পয়মন্ত। জেলের নৌকায় যতো হাত বাড়ে ততো আয় রোজগার বাড়ে। এ ঠিক চাষার সন্তান হবার মতো।
: এমনভাবে বললি যেন কতো চাষার সংসার দেখেছিস তুই। হেসে বলত মক্ষীজান।
হেসে ফেলত কৈতরীও। তা ঠিক চাষার জীবন আমরা দেখিনি। দেখবোও না এ জনমে। আমার ভাল লাগছে, আমরা ঠাকুরদা ঠাকুমা..
: ভগবান যেন সব ঠিকঠাক মতো পার করে!
ঠিক মতোই পার হলো সব। পক্ষীর কোল আলো করে যেদিন প্রথম ছেলের জন্ম হলো সেদিন নদীর রূপোলী জলে নেমেছিল চাঁদের আলোর সোনালি ঢল। রূপোলি আর সোনালি মিলে মিশে অদ্ভুত এক রং-এর সৃষ্টি করেছিল। সে রঙের নাম ওরা কেউ জানেনা। রূপসা নদীর ওপর দিয়ে চলছে তখন তাদের জেলে বহর। সন্ধ্যে থেকেই পক্ষীর শরীরে কেমন যেন অস্বস্তি। কেমন এক চিনচিনে ব্যথা। বলব বলব করেও লক্ষণকে বলতে পারেনি পক্ষী লজ্জায়। লক্ষণ তখন নৌকার পাটাতনে শুয়ে বিড়িতে লম্বা এক সুখটান দিচ্ছিল। সইতে না পেরে একসময় আর্তনাদ করে উঠেছিল পক্ষী। সে আর্তনাদ গিয়েছিল লক্ষণের কানে।
: কি হলো, হলো কি কাৎরাস কেন?
: সময় বুঝি হয়ে এল। পাশের নৌকা থেকে শাউড়ি মাকে ডাক নইলে আমার মাকে।
: আরে তাদের ডাকার আগে ডাকা দরকার ধাই পিসিকে। নৌকাটা ডাঙ্গায় ভেড়ানোও দরকার। নৌকা পারের দিকে নিতে নিতে কয়েকটা নৌকা পরের একটা নৌকার দিকে তাকিয়ে মুখে হাতের আড়াল করে চেঁচিয়ে ডেকেছিল,
: হেই দাই পিসি, হেই হেই। নৌকা ভিড়া। বউ-এর সময় হইছে। ধীর হয়ে গিয়েছিল জেলে বহরের নৌকাগুলো। দ্রুত দুপাশ থেকে দুটো নৌকা এগিয়ে আসছিল লক্ষণের নৌকার দিকে। লক্ষণের মা আর শ্বশুরের নৌকা। লক্ষণ ওদের ইশারায় ডাঙ্গায় নৌকা ভিড়াতে বলেছিল। একে একে বেশ কয়েকটা নৌকা ভিড়েছিল ডাঙ্গায়। ধাই পিসি নৌকা ভিড়িয়ে উঠে এসেছিল লক্ষণের নৌকায়। বলেছিল লক্ষণকে নৌকা থেকে নেমে যেতে। নৌকায় উঠে এসেছিল কৈতরী আর মক্ষীজান। জর্ঢু কাপড়ের আড়াল পড়েছিল নৌকার দু’পাশে। আর পাড়ে বসে ছটফট করছিল লক্ষণ। শুনতে পাচ্ছিল পক্ষীর কাতরোক্তি। তারপর একসময় সে কাতরোক্তি থেমে গেল। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল এক নবিন মিহি কন্ঠ। লক্ষণ দৌড়ে উঠতে গেল নৌকায়। ঠিক তখনই বেরিয়ে এলো ধাই পিসি। হাতের রক্ত নদীর জলে ধুতে ধুতে বলল,
: এখন না, এখন না, ছেলে হয়েছে, মিঠাই আন
সেদিন সেই…
দুর্বল অসক্ত শরীরে ছেলেকে আদর করার তেমন সুযোগ পায়নি পক্ষী। লক্ষণ যেন ছেলেকে আদরের পুরোটাই ভরিয়ে দিতে চাইছিল। তার চোখ মুখে ফুটে বেরুচ্ছিল অপরিসীম আনন্দ। সে মুখের দিকে তাকিয়ে বড় আনন্দ পেয়েছিল পক্ষী!
সময়িকভাবে মাছধরা বন্ধ হয়েছিল পক্ষীর। ছেলে জন্মাবার আগে বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন। এখন পক্ষীর অনেক কাজ। ছেলেকে খাওয়ানো দাওয়ানো কাজল পরানো। ছেলেকে কোলের উপর নিয়ে কাজল পরাতে পরাতে নদীর জলের দিকে তাকিয়ে সুর করে ছড়া কাটে পক্ষী। জলেতে জন্ম নিলা/ কোলেতে আইল চন্দ্র মোর/ কাজল দিলাম দুই চক্ষেতে/ রাত পুহাইয়া হইলা ভোর। খিলখিল করে হাসে পক্ষী। লক্ষণ বলে,
: এ ছড়া তুই পাইলি কই?
: কেন বানালাম। মিল হয় নাই? না হোক এটা আমার অমিলের ছড়া
: খুব মিল হইছে। হাই ভগবান! তুই ছড়াও মিলাস। এতকিছু পারিস!
: তা পারি। খালি পারিনে ডাঙ্গায় থাকতে। মানুষ যে কী করে ডাঙ্গায় থাকে আমি বুঝিনা। আমি ডাঙ্গায় দু’চারদিন থাকলে মারাই যাবো। নৌকা আর তার নিচের অথৈ পানি এই তো আমার জীবন।
: ডাঙ্গায় থাকার কথা তোর মনে হল কেন? আমরা জলের মানুষ। জলেই আমাদের জীবন মরণ।
লক্ষণ মাছ ধরে। অলস লক্ষণের একার রোজগারে সংসার খরচায় টান পড়ে। খরচও বেড়েছে। দুধের খরচ, চিনির খরচ। ছেলে নিয়ে মেতে থাকার সময় পায়না পক্ষী। আবারও হাতে তুলে নিতে হয় জাল। আর এভাবেই কাটে সময়।
বছর ঘুরে আর একটি করে সন্তান আসে পক্ষীর কোলে। কখনও ছেলে, কখনও মেয়ে। এইভাবে কখন যেন ছয়টি ছেলে মেয়ে এসে ভরে ফেলে তার পুরো নৌকা। ছেলেরাও এখন বাপ মার সাথে একটু আধটু মাছ ধরে। সময় গড়িয়ে চলে। সংসারে অভাব তেমন নেই। আর অভাবই বা কী। জেলে পরিবারে কতোটুকুই বা চাহিদা। বড় ছেলে রূপস বিয়ের যুগ্যি হয়েছে। মেজোটারেও এখন ইচ্ছে করলে বিয়ে দেয়া যায়। লক্ষণের বাপ মা বিয়ের পর তাদের আলাদা নৌকা করে দিয়েছিল। পক্ষীর তা ইচ্ছে নয়। পক্ষীর ইচ্ছে নৌকাটাকে বড় করা। সে নৌকায় আলাদা আলাদা কামরা থাকবে। সেখানে ছেলে মেয়ে বউ নাতি নাতনি নিয়ে থাকবে পক্ষী। পক্ষীর চোখ জুড়ে অনেক স্বপ্ন দোল খায়। মেয়ে দুটোর জেলে বহরেই বিয়ে হয়েছে। তারা চলে গেছে আলাদা নৌকায়। এখন তো কেবল চারটে ছেলে। ওদের নিয়ে বড় একটা নৌকায় একত্রে সুখের সংসার গড়বে পক্ষীজান।
পক্ষীর বয়স হয়েছে, বয়স হয়েছে লক্ষণেরও। চিরকালের আরামপ্রিয় লক্ষণ এখন আর কাজ করতে চায়না। কিন্তু জেলে জীবন যে বসে খাওয়ার নয়। পক্ষী এখনও আগের মতো মাছ ধরে। প্রচুর মাছ পায় সে। কী দুপুর, কী সন্ধ্যে, কী মাঝরাত মাছ ধরে পক্ষী। তার শুধু একখানাই স্বপ্ন একটা বড় নৌকা বানানো। আর নৌকাখানা হবার পর দু’ছেলের একসাথে বিয়ে দেবে পক্ষী।
সারাজীবনের জমানো পয়সাগুলো একসাথে করে পক্ষীজান। পুরোনো নৌকা বেচে যে টাকা পায় সে টাকার সাথে জমানো টাকা মিলিয়ে বেশ বড় একখানা নৌকা কেনে। আর সেই নৌকা কিনে আনন্দে শিশুর মতো আত্মহারা হয়ে ওঠে পক্ষী!
: বুঝলি বাবারা ডাঙ্গার মানুষেরা ছেলে পিলের বিয়ে দেয় আর আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু আমরা তেমন না। এই দেখনা নৌকা বাড়ালাম কি জন্য বল দেখি?
ছেলেরা মাথা নাড়ে। সত্যিই তারা জানেনা মা হঠাৎ করে নতুন বড়সড় একখানা নৌকা কেনার জন্য অস্থির হয়ে উঠল কেন।
লক্ষণ হাসে। বলে,
: আমি জানি। আমি জানি তোর মনের ইচ্ছে। তুই ছেলেদের বিয়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকতে চাস। ঠিক না?
ছেলেরা লাজুক হাসে।
জেলে বহরে যাদের মেয়ে আছে তাদের সাথে কথাবার্তা চলতে থাকে। পক্ষীর যেন বড় তাড়া। সময়ের কাজ সময়ে করা উচিত। বয়স বাড়িয়ে ছেলে মেয়ের বিয়ে দেয়া ঠিক না। তাছাড়া সে অতি দ্রুত নাতি নাতনির মুখ দেখতে চায়। তাদের সাথে খেলতে চায়।
বিয়ের কথা পাকা হয়ে যায়। বড় সুন্দর দু’খান মেয়ে পেয়েছে ছেলেদের জন্য। পক্ষীর মনে আনন্দ ধরেনা। সে জেলে বহরে ঘোষণা দিয়েছে দু’ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে খুব ভাল খাওয়াবে। মাছ হবে, মুরগি হবে। সারাজীবন তো বড় বড় মাছ ধরেছে আর বাজারে বিক্রি করেছে। নিজেরা ভাল কিছু কখনও খায়নি। এবার সবচেয়ে বড় মাছগুলো সে বহরের লোকদের খাওয়াবে।
বিয়ের আগের রাতে নৌকা নিয়ে নদীর সেই জায়গাটাতে যায় পক্ষী যেখানে মাঝের বিস্তর সমাগম। এখানে জাল ফেললেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ। তবে মাছ ধরতে ধরতে এখন অনেক কম মাছ পাওয়া যায়। তবুও যা পাওয়া যায়-অন্য জায়গায় তা পাওয়া যায়না। লক্ষণ মাছ ধরতে যায়না। বলে, আজ শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। তাছাড়া কাল বিয়ে, আজ আর মাছ ধরতে চাইনে।
: ও কথা বললে হবেনা। অনেক মাছ লাগবে কাল। বড় বড় মাছ। জেলে বহর দেখতে ছোট হলেও মানুষ কিন্তু কম না।
জোর করে লক্ষণের হাতে জাল তুলে দিয়েছিল পক্ষী। তারপর দু’জন অনেক ঘুরে ফিরে হিসেব কিতেব করে জাল ফেলেছিল। দু’চারবার জাল ফেলা আর উঠানোর পর দু’জনেই হতাশ হয়ে গিয়েছিল। আজ মাছেরা যেন স্ট্রাইক করেছে। বড় মাছ তো দূরের কথা, কোনো মাঝারি আকারের মাছও জালে ধরা দিচ্ছিল না। এমন হলে বাজার থেকে কিনে মাছ খাওয়াতে হবে বহরের লোকদের। কিন্তু নৌকা কিনতে গিয়ে হাত একেবারে খালি। তাছাড়া দুই ছেলের বিয়ের খরচ। মাছ কেনার পয়সা পাবে কোথায়? তাহলে কী কথা রাখতে পারবে না পক্ষী। মান সম্মান সব যাবে। চেঁচিয়ে লক্ষণকে বলে,
: হাত গুটিয়ে বসে আছিস কেন। জোরে জাল ফেলনা।
: আর না, আমি আর পারছিনে। ক্ষেমা দে।
: না না আত্মীয় স্বজনদের মাছ খাওয়াতে হবে। নিজে এসে লক্ষণের হাতের জালটা ছুঁড়ে দিয়ে জালের সুতো ধরিয়ে দেয় লক্ষণের হাতে। নিজের জাল ছুঁড়তে যাচ্ছে এমন সময় লক্ষণ চেঁচিয়ে বলে,
: বড় কোন মাছ পড়েছে বুঝি জালে। আমি ধরে রাখতে পারছিনে। তাড়াতাড়ি আয়।
পক্ষী তাকিয়ে দেখে জালের টানে লক্ষণ দুলছে। হায় ভগবান নিশ্চয়ই কোন বড় মাছ পড়েছে জালে। এই মাছটা তুুলতে পারলেই হবে। লক্ষণকে আজ আর জাল বাইতে দেবেনা। বেচারা সত্যিই বড় ক্লান্ত। দ্রুত লক্ষণের হাতের জাল ধরতে যায় পক্ষী। সে নিজেও টানবে। দু’জন মিলে টেনে তুলবে জাল। উঠবে বিশালাকার মাছ। সেই মাছ কেটে বড় বড় টুকরো করে ভাজি করে খাওয়াবে বহরের লোকদের। সবাই ধন্য ধন্য করবে। বলবে পক্ষীজান আর লক্ষণ যা খাওয়ালো না। এমন কখনও কেউ খাওয়ায়নি। মনে আনন্দ নিয়ে লক্ষণের হাতের জাল টানার জন্য হাত বাড়ায় পক্ষী। আর ঠিক তখনই হাত থেকে ছুটে যায় জাল। জালের টানে পানিতে পড়ে লক্ষণ। মুহূর্তের মধ্যে বিকট একটা জন্তু ধেয়ে এসে গিলে ফেলে লক্ষণকে। জলজীবনে বসবাসকারী পক্ষীর জন্তুটাকে চিনতে একটুও দেরি হয়না।
শেষ পর্যন্ত হাঙ্গরের খাদ্য হতে হবে লক্ষণকে এ কখনও ভাবেনি পক্ষী। অপরাধবোধে আবারও নিজেকে জর্জরিত করে পক্ষী। লক্ষণ মাছ ধরতে যেতে চায়নি, সে কেন তাকে দিয়ে জোর করে মাছ ধরাতে গেল।
ছেলেদের বিয়ে হয়ে যায়। দুই বউ এসে ওঠে নৌকায়। আর লক্ষণের মৃত্যুতে একা হয়ে যাওয়া পক্ষী বড় দ্রুত বুড়িয়ে যায়। এখন আর জাল ফেলতে পারেনা। হাত পা কাঁপে। ভাত রাঁধতে পারেনা। কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে পড়ে যায় হাড়ি। এমন অথর্ব লোকের ভার কে বইবে! দু’বউ বিরক্ত হয়ে ওঠে। উঠতে বসতে খাওয়ার খোঁটা পক্ষীর আর সয়না। কিন্তু এই খোঁটা সহ্য করেও যে তাকে থাকতে হবে। মেজ বউমা পোয়াতি। তার বাচ্চা নিয়ে সময় কাটাবার স্বপ্ন এখনও পক্ষীর মুছে যায়নি। বছর ঘুরে গেল বড় বউমার কেন সন্তান হচ্ছেনা এ নিয়েও পক্ষীর চিন্তা। ছেলেকে দু’চারবার বলেছে বউকে দাওয়াই খাওয়াতে। ছেলে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে,
: তুই চুপ থাকতো মা
বউ ঝঙ্কার দিয়ে বলেছে,
: কাজ করার মুরোদ নেই। কিল মারার গোসাই।
বউ-এর কথা কানে মাখেনি পক্ষী। সত্যিই তো তার কাজ করার মুরোদ নেই। ওরা কতো কাজ করে, কতো খাটে। আর সে শুধু বসে বসে খায়, এ কথাওতো সত্যি। তাছাড়া বউ দুটো তার মেয়ের মতো। ওদের কথা কী গায়ে মাখলে চলে!
: এতো বকি এত চিল্লাই তবু লজ্জা নাই। রাগ করে একদিকে চলে গেলেও তো পারে।
পক্ষী ভেবে পায়না সে কোথায় যাবে। কিন্তু পক্ষীকে বিদায় করার জন্য ছেলেদের উপর বউদের চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
আর এক সকালে সত্যিই এক ডাঙ্গায় নৌকা ভিড়ায় রূপস। মাকে হাত ধরে নামিয়ে দেয়। পক্ষী হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
: আমাকে নামাস কেন, নামাস কেন? আমি কোথায় যাবো?
: ডাঙ্গায় যা। মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে খা। একটাতো পেট
: না ডাঙ্গায় যাবোনা। তাছাড়া মেজ বউ-এর সন্তান হবে, আমার পুতি হবে। আমি তাকে কোলে..
কথা শেষ হবার আগেই নৌকা ছেড়ে দেয়। পক্ষী পানি ভেঙ্গে কিছুদূর নেমে নৌকা ধরতে চেষ্টা করে। ধপ করে পড়ে যায় পানিতে। হেঁচড়ে-পিচড়ে ওঠে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখে তার চোখের সামনেই একসময় নৌকাটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়।
ঘুরে দাঁড়ায় পক্ষী। হাঁটতে থাকে। পানির মানুষ সে, ডাঙ্গায় হাঁটার অভ্যেস নেই। কিন্তু আজ যে তাকে হাঁটতেই হবে। হাঁটতে হাঁটতে একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় এসে বসে পক্ষী। ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। পক্ষী কাঁপা হাত দিয়ে ক্ষুধার্থ পেটে হাত বুলায়। ঠিক তখনই পাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে, ভিক্ষে দাও গো, ভিক্ষে।
পক্ষী তাকিয়ে দেখে ছোট একটা ছেলে ভিক্ষে চাইছে।
: ভিক্ষে করিস কেন, তোর বাপ মা নেই?
ছেলেটা মাথা নাড়ে।
: কে আছে?
: কেউ নেই।
: আমি তোর এই ঠাকুমা আছি।
ছেলেটার হাত ধরে পক্ষী। তার মনে হয় মেজ বউমার অনাগত যে সন্তানের জন্য সে অপেক্ষায় ছিল সেই সন্তানই বুঝি তার হাত ধরেছে।