চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি গলিতে বা’দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল- ডানদিকে পর পর দু’টা টিনশেড বাংলোবাড়ি আম-কাঁঠাল গাছের ছায়ায় নিঝঝুম। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে লেনে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেডে এলাকার একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেস বাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন। এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তারা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।
ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে ভাঙা টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সাথে সাথেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।
সুবাসটা চেনা চেনা অথচ মোটেই চেনা নয়, হাসিটাও এই রকম। ইলিয়াস চকিতে ভাবে মানুষকে চেনার আগেই বোধহয় হাসি চেনা যায়। হাসি মানুষে-মানুষে সম্পর্কের একটা আদি নির্ভরযোগ্য সেতু।
এই তত্ত্ব কথাটা ভাবতে পেরে ইলিয়াস নিজেই মুচকি হাসল। স্কুলে আজ হেডমাস্টার সাব বলে দিয়েছেন, আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব। আপনার জন্য বোধহয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন। একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল মাস্টারির চাকরির জন্য রেকমেণ্ড করে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন তাহলে কী করা যাবে!
আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন, একটা দাবি আছে আপনার। কিন্তু আমার করার নেই কিছুই। তবে আমি কথা দিচ্ছি দুয়েকটা ভাল টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেবার চেষ্টা করব।
মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়-এরকম কথা বলা হয়ে থাকে। তবে সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। আর মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না। যেখানে অশ্বক্ষুরের দাগের পরিমাণ ফাঁক-ফোঁকরে ননী-মাখনের খানিকটা আভাসও করতলের বাইরে থাকে না।
এই হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। ভাঙা টিনের গেটে হাত রাখার সাথে সাথে ওই হাসি আজও দুরন্ত ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ল। তার হাত যদি ওই মন্ত্রীর হাত হত তাহলে এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত। তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে। এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে। এই নাড়ার শব্দ ঝরণার মত বইছে এখন তার বুকের ভেতর। মন্ত্রীর হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে তার উপর ঝরণার পানি পড়তেই বেদনা আেঁয়ার মত উড়তে থাকল।
মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে হাত ঝাড়ছিল।
ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে হাত ঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে ওঠল, কি কাম হইয়া গ্যাছে? হবে না ভাই, আপনের কপাল ভাল। কইছিলাম না, চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই, আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব, আমি তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়নই আলাদা। এই রকম কপাল দেখলেই চিনবার পারি। হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি। কত কপাল দেখছি। অহন এক নজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপাল-তত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই। এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।
রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুঁড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠল। ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে।
সে জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই রফিক ভাই।
রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই? হয় নাই ক্যান? আপনে তো তিন মাস কাজ করছেন। অহন তো আপনে ডিপার্টমেন্টাল ক্যাণ্ডিডেট। রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।
ইলিয়াস বলল, এই যে কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা এ্যালট হয়েছে। তারপরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?
রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই এই কিচ্ছা না কতদিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি। তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না। পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।
ইলিয়াস বলল, কন কী। হুমকি দেয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?
রফিক বলল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম, গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব। হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবর দখল কইর্যা রাখছে বাসা, ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়- শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কী আর বুঝি না! জানেন ছোটবেলায় গেরামে দেহ-তত্ত্বের গান শুনছি আর অহন এই নব্বুই সনে ঢাকার শহরে দেখছি দেহ-শিল্পের দাপট।
ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন ম্যাসলম্যানদের হাতে জিম্মি। এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না।
রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন? এই যে মেয়েটা আমাদের রীতিমত হুমকি দিয়া গ্যাল, সে কি ম্যাসলম্যান? এ হল সফ্টম্যাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ। এখন সফটওয়্যারের যুগ।
ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।
রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইমু। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো মেলা নভেল-টভেল পড়েন। দেখেন না, আজকাল সব মর্ডান জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শটহ্যাণ্ডের মত সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই-ভাবনা নাই। কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফর ফর কইর্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।
ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায় রফিক ভাই। আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও।
রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা! দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।
লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানিং খিটখিটে হয়ে ওঠেছে। তবে সময়মত খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভুলে না।
খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সাথে সাথে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল। সে এখন থই থই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে। কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে। কি দেখবে? কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মত একটা ভোর ওঁৎ পেতে রয়েছে। এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে। দম আটকে আসে তার।
ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের উপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়- ঢক ঢক করে খানিকটা পানি খায়।
তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?
রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান। ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না। যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র। এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে এই থাকবার একটা ফরম্যাট আছে। ওইটা আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে। হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত। পানির মত জীবন। নেন, ঘুমান।
ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন, ঘুমান নাই?
রফিক বলল, হঠাৎ আপনের ভাবীরে দেখলাম।
ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবীরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?
রফিক হেসে ওঠে, আরে না, ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!
ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবীরে দেখলেন কেমনে?
রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল, যাই গা ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো।
ইলিয়াস থ! লোকটা বলে কি? মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ করে যায়- কোন কথা বলে না।
অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে, কি ঘুমাইলেন?
ইলিয়াস সাড়া দেয় না।
রফিক বলল, ইলিয়াস সাব আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন কী কই আপনেরে। জানেন বিয়া করলাম দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল। কিন্তু সংসার করতে পারলাম না।
রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে। এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই আমি যখন এলাম তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?
রফিকের কন্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?
ইলিয়াস বলল, এই কোনো মহিলার!
রফিক আপন মনে আওড়াল, মেয়ে-মানুষের হাসি! কই না তো। ক্যান! আপনে শুনছেন?
ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয়দিন যাবতই শুনি। ভাঙা গেইটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন মিষ্টি হাসি…
রফিক হেসে ওঠে, দূর আপনে শোনেন আর আমি শুনিনা- এইটা হয় না কী! এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে। ফাঁক পাইলেই বাইর হয়।
ইলিয়াস বলল, এ কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি- একদিন-দুইদিন না। গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি। মিষ্টি সুরেলা গলায় হাসি। ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে।
রফিক ওকে থামিয়ে দেয়, ব্যস হইয়া গ্যাছে। আর কইতে হইব না। আপনের ভাবী যে আইস্যা দাঁড়াইল। এইটা ক্যামনে? আরে ভাই ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে তখনি বাইর হয়।
ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে। সে বুকে হাত দেয়। অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কী-না!