গুচ্ছ কবিতা: ফজিলা ফয়েজ


এক টুকরো অগ্নিরাশীতে

পৃথিবীর ভয়ংকর রূপ তোমার চোখেই দেখছি বাকরুদ্ধ হয়েছি চক্ষুতারা বিবর্ণ হয়েছে।
গগনে মেঘের আমেজ নেই অকস্মাৎ হৃদয়কম্পন, বজ্র ধ্বনি,
বালুকণাতে আলোর ঝিলিক সঞ্চার হল আকাশ ফাটিয়া ছাই চাপা আগুনের মত।
মনের আনন্দে পা বাড়িয়ে হাঁটতে থাকি প্রান্তরেণু জগতের বুকে।
আধা নিভু জীবন প্রদীপ টলমল করে ভাগ্যের রেখাচিত্তে।
সুখের বুক ফুঁড়ে চিরন্তর কান্নার ফোয়ারা এক টুকরো অগ্নিরাশীতে ফিরে পাই নব যুবা জীবন।

সময়ের সুর

ইতিহাসের পাতায় চিরকাল ঘড়ির পেন্ডুলামে দুলছে চারপাশের রহস্যময় অন্ধকার
ঘণ্টার শব্দে সময় হারায় চিরন্তন ছন্দে হিমশীতল প্রাণে অনুভব হয়।
কালের মোড়ে অজানা পথের যাত্রা
খরস্রোতা নদীর কলধবনিতে হারিয়ে যায় সব সুর।
ধ্রুবতারা মিশে থাকে রাত্রির গভীর সাঁঝে
সভ্যতার অগ্নি নিভে গেছে বিপথগামী সময়ের মাঝে
প্রাচীন ছন্দে গড়ে ওঠে জীবনের প্রহেলিকা রচিত হয় সেসব গল্প।
কান পাতলেই শোনা যায় ইতিহাসের দোলনার গান
এভাবেই ঘুরে চলে ইতিহাসের অশ্রু ও আনন্দের সন্ধান।

হৃদয়খন্ডের অগ্নিশিখা

গোলাপের পাপড়ির মত দু’গাল বেয়ে একেবেকে নামছে স্রোতস্বিনী।
দজলার ঢেউয়ের মত রহস্যময়।
কবিদের উপমা কালো হরিণী চোখ কাম্পিয়ান সাগরের মতন অতলান্ত।
আমার অর্থহীন চাহনি আর ঠোঁটে চেপে ধরা চিৎকার শিথিল হয়ে যায়।
এক ঝলক হতাশা সমস্ত সত্তা নড়বড়ে করে দেয়।
মাংস পেশী জড়িত অন্তরস্থ হৃদয়ক্ষণ্ডে আছে অগ্নি
ঘোর অন্ধকারে অসংখ্য অগ্নিশিখা সহস্য প্রকারে ধূম উদিগরণ করে।

নদী

সীমান্তের সেই নদীটি গায়ে জোছনা মেখে নাচতে নাচতে ছুটে চলছে
বিদ্যুতের করাতের মত বুক ফেড়ে।
শত বছরের চেষ্টায় নির্মিত যে ইমারত
নিমিষেই ভেঙে চুরমার।
এভাবেই ভেঙে যায় কত মনের শিশমহল কেউ কী তাহা দেখতে পায়।

অতীতেও কত নদীর ধারা এভাবেই চলছে
কত ঝড় তুফান পেরিয়েছে
কখনোবা কিশতি পাড়ে এসে ভরাডুবি হতে চলেছে তবুও নদীর বিরাম নেই।

অজানিত পিছুটান

জিব দিয়ে অনুভব করি ঠোঁটের খুন পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ যেনো অতৃপ্ত পিপাসার মানবী।
বিস্মিত! অজানিত আশঙ্কার অনল বুকের ভিতর বইতে থাকা এক পাথর কাটা স্রোত।
আধার গহ্বরে ঠাঁই নিয়েছে মৃত্যু ক্রোর।
জরাজীর্ণ গতরে অধিকারের খুঁটি গেড়েছে বিষণ্নতা।
পিছুটান কি কবিত্ব?
পিপাসা কি কাগজবন্দি অমরত্ব?
জগতে মৃত্যুর মত এত সুন্দর স্নিগ্ধ আর নিস্তব্ধ কিছুই নেই।

জীবনের যৌবন

খাস্তা শরতের সকাল
পায়ের তলায় কুচকে যায় গাছের পাতা।
পথের উত্তপ্ত পূর্ণ যৌবনা ধুলির হাড়গোড় ভেঙে পড়েছে হিম কুয়াশার আবরণে।
তাকিয়ে থাকি সেই ফেলে আসা পথের প্রান্তরে
জীবনের যৌবন বয়ে গেছে হাতের নাগালে।
কি রহস্যময় জীবন ও সময় অদ্ভুত দেহঘড়ি।
স্প্রিংয়ের মত জটিল নকশার কারুকাজ
যেখানে অসংখ্য না বুঝা শব্দগুচ্ছ দিয়ে তৈরি হয় গল্প।
হৃদস্পন্দন যখন অবস হয়ে পড়ে
তখন ছোট ছোট গিয়ারগুলি টিক টিক শব্দে নাড়াচাড়া করে
উজ্জীবিত হয় সময় কিন্তু উজ্জীবিত হয়না জীবনের যৌবন।

শূন্যতা আমার পরিচয়

শূন্যতার দহনে পোড়া প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেড়ে যায় মনের আগুন
দুরন্ত বাতাসে স্বপ্ন পোড়ার অনুভুতি
এখন চৈত্র চকচকে রোদে পৃথিবী হাসছে সেখানেও দেখি শূন্যতার নিঃসঙ্গ মেঘমেলায় বসবাস করে অস্পষ্ট অস্তিত্ব।
স্বপ্নগুলো কেটে গেছে শূন্যতার রাশিতে
,ছেড়ে গেছে কেবল একাকিত্বের ছায়া।
হাহাকারের সুর নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়েছে শুষ্ক আবহাওয়ায়।
নিঃসঙ্গ পথিকের অনন্ত পথযাত্রায় খোঁজে হিমশীতল বাতাস।
সে কি ফিরবে উত্তরীয় হাওয়ায়?
আঁকড়ে ধরবে বেদনার স্মৃতি?
কখনো কি হবে ধূসর কালো রঙের সোনালি রূপান্তর?
মনের মধ্যে জমে থাকা বিষাদ হয়ে ওঠে তাসমিক।
শূন্যতার সাক্ষরে আঁকা এক টুকরো পরিচয় তলদেশে ডুবে থাকা বিষণ্নতার অগাধ জল।

বিপ্লবী

আমি বিক্ষোভের মিছিলে দাঁড়িয়ে উত্থানের ভূমিকায়।
দেখি সমাজের দুর্বলতা, বেজে ওঠে কোলাহলের শব্দ,
ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ভীষণ দাগ প্রকৃতির উপরে।
বাহুক্ষত মানবের হৃদয়ে সহস্র প্রহর
শক্তিহীন জনতা মৃত্যুর কারাগারে একা বসে।
বিচার কাকে দেওয়া হবে?
ক্রোধের অগ্নি দেহ জ্বালায়
আমি উঠবো জেগে জনতার হয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বেলে।
বিপ্লব এসেছে আজ পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে।

অদ্ভুত নেশা

অদ্ভুত নেশা জলাতঙ্কের মত ছড়িয়ে পড়েছে মস্তিষ্কের আগাগোড়ায়।
তবুও আতঙ্ক সরিয়ে দ্বিধাহীন ছুটে চলা নগরের শেষ প্রান্তরে।
নিপীড়িত জনতা পিষে মরে পায়ের তলায়।
চাকচিক্যে ঝলসে গেছে প্রহরীর দু’চোখ।
তাইতো প্রশ্নবিদ্ধ করেনা মুখোশধারী সমাজকে।
অর্ধ বয়সী নারী র অন্তঃসত্ত্বা , উস্কো খুস্কো চুলে দাড়িয়ে থাকা কিশোরীর অপলক চেয়ে থাকা।
ঘোর অমানিশায় বিমূর্ত অন্ধকারে।
লজ্জাহীন ভাবে বেচা কেনা হচ্ছে চড়া দামে বিবেকের ক্ষমতাশীল খরিতদার কাছে।

বৈশাখের বেদনা

আকাশে আগুন বাতাসে ঝড় নিয়ে
ঢেউ তোলা রাগে বৈশাখ এলো।
স্বপ্নে বোনা একটুকরো ভালোবাসার ছাদ
গৃহস্থ ভেঙে লণ্ডভণ্ড।
ঝড়ে উড়ে গেল জানালার কপাট।
ভেঙে পড়লো দেয়ালে লটকানো পুরনো ফটোখানা
হৃদয়ে বাজলো শোকের পাঠ।
পাঁজরের খাঁচায় বাজে বিষণ্ন সুর,
পথে ঝরে পড়া কাঁচা আমের মতন—
বেদনাতে ভিজতে থাকে চোখ,
দরজায় হেলে পড়ে যত্নের রক্তজবা।
বৈশাখ শুধু আকাশে আগুন নয়, সে তো
ভেতরেও তোলে কষ্টের প্রলয়।

তবুও…
এই ভাঙা ঘরের ছাউনিতে একদিন শান্তির বৃষ্টি নামবে
বৈশাখ শেষে শ্রাবণ এলে—

জন্ম নিচ্ছে এক অসুস্থ ইতিহাস

পৃথিবী আজ ধ্বংসস্তুপে শুয়ে,
চেনা শহর ভেঙে পড়ছে ভেঙে গেছে শিশুর খেলনা
মাটির নীচে চাপা পড়ছে মায়ের কোল।
ইট-পাথরের চাপায় ঘুমিয়ে থাকে লাশ
প্রকৃতির কণ্ঠে নিঃশব্দ ক্রন্দন
নীল আকাশ সবুজ মাঠের বুকে ট্যাঙ্কের চাকা গড়ায়।
ধূসর রঙে নিষিক্ত হওয়ায় লাশের গন্ধ
গোলাবারুদের কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় আকাশ
নিভে যায় আলো।
সূর্য ওঠে যেন বিবর্ণ এক প্রাণ।
এ কেমন সভ্যতা?
কিসের উন্নয়ন?
জীবনের দাম যেখানে নিমেষেই খবরের শিরোনাম।
শিশুর হাসি থেমে যায় বুলেটের মুখে,
বৃদ্ধ পিতার মুখে চিৎকার শুকিয়ে যায়।
কারো প্রিয়জন লাশের সারিতে,
জন্ম নিচ্ছে এক অসুস্থ ইতিহাস।

পৃথিবী আজ প্রশ্ন করে মৌনতায়—
এই কি তবে মানুষের পরিচয়?
কে বানাল এই মৃত্যুর মঞ্চ?
রক্তাক্ত পথের নরকযাত্রার ট্রেন তবে থামুক।