মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ নিজেকে চিনতে চেয়েছে, জানতে চেয়েছে নিজের মতো করে। নিজস্ব সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে অন্যের মাঝে নিজেকে চিনবার জানবার প্রবণতা প্রতিটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ পাল্টে নিয়েছে নিজেকে, তেমনি কবির হাতে কবিতার গতিপথ বদলেছে। আধুনিক বাংলা কবিতা সময়ের প্রয়োজনেই গতিপথ পাল্টেছে। বাঁক নিয়েছে অনেকটা নদীর মতোই।
“মানুষ স্বভাবতই রূপবিলাসী স্রষ্টা। এজন্য স্বকীয় ভাবনা-কামনাকে রূপাশ্রয়ী করিবার ইচ্ছা তাহার সহজাত বৃত্তি। মানুষ বলিয়াই হয়তো সে রূপমুগ্ধ। সে যাহা চায় তাহাকে সে রূপের মধ্যে দেখিতে চায়। তাহার কামনা ও কল্পনা যতই সীমাহীন বা সূক্ষ্ম হউক না কেন, উহাকে সে রূপের বন্ধনে আনিতে না পারিলে তাহার মন যেন শান্তি পায় না……..সুতরাং আত্মপ্রকাশের কামনা, পারিপাশ্বিকের সহিত সংযোগ-কামনা, কল্পজগতের প্রয়োজনীয়তা, এবং রূপপ্রিয়তা এই চারটিই মোটামুটি হিসাবে মানুষের সাহিত্যসৃষ্টির উৎস।” [সাহিত্য সন্দর্শন/ শ্রীশচন্দ্র দাশ/ পৃষ্ঠা-১৭]
যিনি সৃষ্টি করেন তিনিই স্রষ্টা; অর্থাৎ যিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেন তিনিই সাহিত্যিক। সাহিত্যিক আমাদের সমাজেরই একজন, তাঁর বেদনাবিদ্ধ কিংবা আনন্দঘন মনোজগতে যে ভাবের উদ্রেক হয়- সে ভাবকে কল্পনার মোড়কে জড়িয়ে, রূপলাবণ্য মিশিয়ে সাহিত্যিক যখন তাঁর পূর্ণতা দান করেন তখনই তা হয়ে ওঠে সাহিত্য। “সাহিত্য হচ্ছে আলোর পৃথিবী, সেখানে যা আসে আলোকিত হয়ে আসে; কালো এসে এখানে নীল হয়ে যায়, অসুন্দর হয়ে যায়- সুন্দর শিল্পকলা। বাঙলা সাহিত্যকে এমন সুন্দর করে রচনা করেছেন যুগ যুগ ধরে কতো কবি, কতো গল্পকার।” [লাল নীল দীপাবলি/ হুমায়ুন আজাদ/ পৃষ্ঠা ১১]
সময় গড়িয়ে গেছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সাহিত্যও এগিয়েছে, অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। বাংলা সাহিত্যের ঊষালগ্ন থেকে সাহিত্যে নারী ও তার শরীরী ভাষা কবির কলমে কীভাবে চিত্রিত হয়েছে সে চিত্রটিই তুলে ধরবার চেষ্টা করছি।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে এবং বংশ বিস্তারের মূলে ছিলো নারী ও পুরুষের মিলন। সৃষ্টির আঁধার নারী; স্বাভাবিক ভাবেই পুরুষের কামনা বাসনার সঙ্গী নারী পুরুষের কাছে পেয়েছে বিশেষ মর্যাদা।
মানব সভ্যতার শুরুটা ছিলো মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা। সন্তান উৎপাদনের পাশাপাশি সংসারধর্ম পরিচালনায় নারীর ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য। পুরুষের সাথে নারীকে শারীরীক শ্রম দিতে হতো; হাটে- মাঠে-ঘাটে। সংসারকেন্দ্রিক বেড়ে ওঠার প্রবণতা ছিলো না বলেই অন্তরালে গা ঢাকা দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি নারী। ফসলের মাঠে পুরুষের সাথে শ্রম দিয়েছে নারী। ক্ষেতের ফসল গোলায় তুলেছে নারী, সেই সাথে বন থেকে কাঠ এনে উনুন জ্বেলেছে নারী। সংসারের প্রাত্যহিক দাবি মিটিয়ে সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে নারী। এমনতরো সমাজ ব্যবস্থায় নারী হয়ে ওঠে মূল চালিকাশক্তিও। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিস্তৃতি যে দীর্ঘস্থায়ী ছিলো এ কথা বলার অবকাশ নেই; তবে পুরুষতান্ত্রিকতার ছায়া-প্রচ্ছায়াটা ছিলো দীর্ঘসময়।
মূলত কৃষি বিপ্লবের ফলে পাল্টে যায় সমাজ ব্যবস্থা। বিপুল সম্পদের রক্ষণা বেক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় পুরুষের ওপর। সম্পদের বিস্তার, জমির মালিকানা টিকিয়ে রাখা, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক লড়াই, দাঙ্গা-হাঙ্গামার পাশাপাশি নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখার সংগ্রামে পুরুষের জুড়ি মেলা ভার। পুরুষ নেতৃত্বে ও ধারাবাহিকতায় ক্রমশ নারীরা হয়ে ওঠে ঘরমুখি। ঘরমুখো নারীরা সংসারধর্মে অধিক মনোযোগী হবার কারণে ধীরে ধীরে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, তবে সেখানেও মাতৃতান্ত্রিকসমাজ ব্যবস্থারই প্রভাব ছিলো দীর্ঘসময়, যার প্রতিফলন বাংলা সাহিত্যেও দেখতে পাই।
বাংলা কবিতার বয়স মাত্র হাজার বছরের বেশি। এখানে বলে রাখা ভালো ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় লিখিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে দেড়শ’ বছর বাংলা ভাষায় কিছুই রচিত হয়নি? উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ নেই বলে এ সময়টা ছিলো নিস্ফলা। নিস্ফলা মাঠে ফসল ফলেনি বলে সাহিত্যভাণ্ডার ছিলো শূণ্য। সঙ্গত কারণেই এই সময়টাকে আমরা ‘অন্ধকারযুগ’ বলে জানি।
সাহিত্যেও প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি কবি ও সাহিত্যিকরা তাঁদের রচনায় যেভাবে নারীকে চিত্রিত করেছেন তার ধারাবাহিকতায় প্রাচীনযুগে আমরা ‘চর্য্যাচর্য্য বিনিশ্চয়’ বা চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন হিসেবে পাই। যদিও অসমিয়, ওড়িয়া, মিথিলা ভাষার পণ্ডিতরা চর্যাপদকে তাদের নিজ নিজ ভাষার আদি রূপ বলে দাবি করেন। হিন্দিভাষীরাও পিছিয়ে থাকেননি। ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুকুমার সেন, ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত চর্যাপদের ভাষা ও বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, চর্যাপদ বাংলা ভাষায় রচিত, এবং বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন।
চর্যার পদকর্তারা বৌদ্ধ সাধক হলেও চর্যাগীতিকাররা ছিলেন জীবনমুখী। সমকালিন জীবনচর্চা, বৃত্তি, পেশা এসব কিছুই তাঁদের রচনার শ্রীবৃদ্ধি করেছে। চর্যায় নারী চিত্রিত হয়েছে পুরুষের যৌনসঙ্গী হিসেবে। আবার কখনো বাগনিকা রূপে নারীকে এঁকেছেন চর্যাকাররা।
এ প্রসঙ্গে কাহ্নপা রচিত দশ নম্বর চর্যাটির অংশবিশেষ তুলে ধরছি-
১ .নগর বাহিরিরে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ
ছোই ছোই জাসি বামহন নাড়িয়া॥
২ .আলো ডোম্বি তোএ সম করিব মই সাঙ্গ
নিঘিণি কাহ্নু কাপালি জোই লাঙ্গ॥
৩.এক সো পদমা চউসটঠী পাখুড়ি
তহি চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি॥
৪.হালো ডোম্বি তো পূছমি সদভাবে
আইসসি জাসি ডোম্বি কাহেরি নাবে॥
আধুনিক গদ্যে রূপান্তর করলে- ডোমনি নগরের বাইরে তোর কুঁড়েঘর। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাস ব্রাহ্মণ ও নেড়েকে। ও লো ডোমনি, তোর সঙ্গে আমি সাঙ্গা করবো। কাহ্ন নিঘৃণ উলঙ্গ কাপালিক যোগী। এক সে পদ্ম চৌষট্টি পাপড়ি। তাতে চড়ে নাচে ডোম্বী বেচারি। ও লো ডোমনি তোকে আমি সদভাবে জিজ্ঞাসা করি, আসিস-যাস ডোম্বী কার নামে?
চর্যাপদের ২৮ নম্বর চর্যায় দেখবো-
উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহি বসই সবরী বালী
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহান সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী॥
উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহারী
তোহারী নিঅঘরিনী নামে সহজ সুন্দরী॥
নানা তরুবর মৌলিল রেগঅনতল লাগেলী ডালী
একেলা সবরী এ বন হিডই কর্তকুণ্ডল বজ্রধারী॥
তিঅ ধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুহে সেজি ছাইলী
সবরো ভূঅঙ্গ ণইরামণি দারি পেম্ম রাতি পোহাইলী॥
আধুনিক গদ্যে রূপান্তর করলে যা দাঁড়ায়-
উঁচু উঁচু পাহাড় সেখানে বাস করে শবরী বালিকা
শবরী মযূরপুচ্ছ পরিহিত গলায় গুঞ্জার মালা উন্মত্ত শবর, পাগল শবর দোহাই তোমার গোল কোর না [ও তোমার] নিজের ঘরনী, নাম সহজসুন্দরী। নানা তরুবর মুকুলিত হলো।
ওর গগনে লাগল ভাল কর্তকুণ্ডল ব্রজধারী শবরী একেলা এ বনে বিহার করে। ত্রিধাতুর খাট পাতা হলো। শবর মহা সুখে শয্যা বিছাল। শবর প্রেমিক নৈরামণি প্রেমিকা; প্রেমে রাত পোহাল।
উল্লিখিত চর্যা দুটির পাঠ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ; গার্হস্থ্য প্রেমের পাশাপাশি নারী যৌনসঙ্গী হিসাবে পুরুষের মনোরঞ্জন করছে। প্রকৃতির অপরূপ রূপ লাবণ্যে নারীকে সাজিয়েছেন পদকর্তারা। তারপরও সন্দেহ ঘোচেনি। ডোমনি বিয়ে করে কামরস মেটাবার ইচ্ছা যেমন আছে তেমনি সরাসরি ডোমনিকে জিজ্ঞেস করতেও দ্বিধা করেনি, কার নায়ে সে আসা যাওয়া করে।
চর্যপদেও পরবর্তী সময়ে কোনো সাহিত্যকর্মেও সন্ধান মেলেনি বলে পণ্ডিতগণ এ সময়কে অন্ধকারযুগ বলে চিহ্নিত করেছেন। অন্ধকার যুগকে বাদ দিলে আমরা দেখা পাবো মধ্যযুগের। সমাজের অভাব অনটন, ব্যক্তিজীবনের নানারকম খুনসুটি চিত্রিত হলেও নারীর অবস্থান শরীরী মিলনের মধ্যেই উজ্জ্বলতর হতে দেখি; পাশাপাশি মধ্যযুগের সাহিত্যে দেখি অসংখ্য কাহিনীকাব্য ও গীতি কবিতা।
কাহিনীকাব্যগুলো মূলত দেব-দেবীর বন্দনা তথা দেব-দেবীর পূজা প্রচারের জন্যই কহিনীকাব্য রচিত হয়েছিলো। তারমধ্যে ১৪৫০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ অন্যতম। রাধা-কৃষ্ণের আড়ালে গার্হস্থ্য জীবনে নর-নারীর প্রেম-বিরহ, মান-অভিমান ও হাসি-আনন্দের চিত্রই নিখটুতভাবে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ শ্রীবৃদ্ধি করেছেন বড়ু চণ্ডীদাস। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পাশাপাশি রচিত কাহিনীকাব্যগুলোর মধ্যে চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শিবমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ও শীতলামঙ্গল কাব্যেও সন্ধান মেলে এ সমস্ত কাহিনীকাব্যগুলো পুরোটাই ধর্মভিত্তিক এবং দেব-দেবী কেন্দ্রিক।
প্রসঙ্গক্রমে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের’ উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরছি। বংশীখণ্ডে রাধার বিরহ কাতরতা যেন শাশ্বত নারীর বিরহ ব্যথায় মিলেমিশে একাকার হতে দেখি-
কে না বাঁশী বা এ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে
কে না বাঁশী বা এ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদে মোর আওলাইলো রান্ধন॥
কে না বাঁশী বা এ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাত্র নিশিবো আপনা॥
বাশীঁর শব্দে রাধার মন-প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন বসে না কাজে, সব এলো মেলো হয়ে যায়, বাঁশীওয়ালার কাছে সমর্পিত হতে দ্বিধা নেই তার। বড়ু চণ্ডীদাস এভাবেই দেবী রাধার
আড়ালে চিরন্তন নারীর রূপ-লাবণ্য-যৌবন তুলে ধরেছেন। এঁকেছেন নারী হৃদয়ের বিরহ গাঁথা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বিরহ খণ্ডের উদ্ধৃতাংশ দেখে নেয়া যাক-
অ- তোম্মার সমান মোঁঞ রাধা চন্দ্রাবলী
কর রতী অনুমতী পূয় বনমালী॥
নিফল না কর কাহ্ন আমার যৌবন
যাচক জনের কাহ্ন করহ তোষণ॥
আ- এ রূপ যৌবন ভার কাহ্ন বিণি অসার
তা লাগি গরল মোঞে খায়িবো॥
কৃষ্ণ ছাড়া রাধার রূপ-লাবণ্য-যৌবন সবই বৃথা। মিলনের আস্বাদ লাভের জন্য যৌবনকে অবহেলা করে কি লাভ? কৃষ্ণকে না পেলে বিষ পান করতেও দ্বিধা নেই রাধার। যৌবনের জ্বালা তথা শরীরী মিলনে রাধা তৈরি হয়ে আছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মধ্যযুগে আরাকানেও বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছিলো। আরাকানের রাজদরবারে যে কজন কবি স্থান পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আলাওল, মাগন ঠাকুর ও কাজী দৌলত ছিলেন অন্যতম। কবি আলাওল (১৬০৭- ১৬৮০) ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে পদ্মাবতীর রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে তা এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরছি-
পদ্মাবতী রূপ কি কহিমু মহারাজ
তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ॥
আপাদলম্বিত কেশ কস্তরী সৌরভ
মহা অন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব॥
তার মধ্যে সীমন্ত খড়গের ধার জিনি
বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী॥
স্বর্গ হান্ত আসিতে যাইতে মনোরথ
সৃজিল অরণ্য মাঝে মহাসুক্ষ পথ॥
পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনায় হীরামনপাখি রাজা রত্নসেনকে বলছে- ত্রিভুবনে পদ্মাবতীর মতো কেউ নেই। তার মাথার চুল পা পর্যন্ত লম্বা এবং তাতে সবসময় মৃগনাভীর সৌরভ ছড়ায়।
ঘনকালো চুলের অরণ্যে দৃষ্টি যেখানে পরাজিত, তরবারীর তীক্ষ্মতার চাইতেও অধিকতর তীক্ষ্ম তার সিঁথি; মনে হয় স্বর্গ থেকে আসা যাওয়ার জন্য সৌন্দর্যের দেবতা অরণ্যের মাঝে এক তীক্ষ্ম পথ নির্মাণ করে দিলেন।
রমণীর শরীর বিচিত্র তাৎপর্য নিয়ে শিল্প সাহিত্য তথা কবির চিন্তা ও চেতনার বিশাল অংশ দখল করে আছে। সাহিত্যে নারীর শরীর, রূপ-লাবণ্য যে বিস্তৃত মনোমুগ্ধকর বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে তার হিসাব-নিকাশ করার সময় কই!
বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনযুগ ও মধ্যযুগে নারী ও তার শরীরী বর্ণনার পাশাপাশি আধুনিক যুগের কবিদের চিন্তা ও চেতনায় নারীরা কীভাবে চিত্রিত হয়েছে কিংবা আধুনিক যুগের কবির ক্যানভাসে নারীর শরীরী বাস্তবতা কতোটা আবৃত অথবা অনাবৃত ; আরো কতোটা আধুনিক হয়ে উঠলো সে প্রসঙ্গে আসা যাক।
প্রথমেই রবীন্দ্ররচনার বিশাল ভাণ্ডার থেকে দেখে নেবো তাঁর কবিতায় নারীর শরীরী বাস্তবতা কীভাবে ধরা দিয়েছে। প্রেমের পূজারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সমগ্র সৃষ্টি জুড়ে প্রেম ও নারী। তিনি যেমন প্রেমের কথা বলেছেন, বলেছেন বিরহের কথা, এমন কি বঞ্চনা ও উল্লাসের কথাও বলেছেন যার অন্তরালে নীরবে- নিভৃতে নারীর মনোজগৎকেই আলোকিত করতে চেয়েছেন। নারী কখনো দেবী, কখনো প্রেয়সি, কখনো মানসী কিংবা জীবনসুন্দরী; একই সাথে নারী বড় বেশি রহস্যময়ী। সেই সাথে নারী লিলাসঙ্গিনী হিসেবে রবীন্দ্রবলয় আলোকিত করে রেখেছে।
কাব্যসুন্দর প্রেয়সীর অন্তরালে শরীরী বাস্তবতার চিত্র দেখি ‘কড়ি ও কোমল’ পর্বে ‘চুম্বন’ কবিতায়-
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা
দোহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে॥
…………………………………..
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে
দোহের সীমায় আসি দুজনের দেখা॥
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে
অধরেতে থরো থরে চুম্বনের লেখা॥
‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থে ‘লজ্জা’ কবিতায় নায়ক শরীরী মিলনে আগ্রহী তখন নায়িকাকে বলতে শুনি…
থাক বধূ, দাও ছেড়ে,
ওটুকু নিয়ো না কেড়ে
এ শরম মোরে দাও রাখিতে-
নায়িকা কি ছলা-কলার আশ্রয় খুঁজছিলো? কেননা পরবর্তী মুহূর্তেই নায়িকাকে বলতে শুনি-
বসন্তনিশীথে বধূ
লহো গন্ধ, লহো মধু।
সমর্পিত হয় নারী। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ঢেলে দেয়ার মানসিকতায় প্রস্তুত। সবটুকু প্রেমাস্পদকে তুলে দিতে আর দ্বিধা নয়।
‘মানস সুন্দরী কবিতার উদ্ধৃতাংশ দেখা যাক-
দু’টি রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও মৃণাল পরশে
রোমাঞ্চ অঙ্কুরি উঠে মর্মান্ত হরষে
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল,
মুগ্ধ তনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের সীমান্ত প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে
এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে।
রিক্তহস্ত, কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, মুগ্ধতনু, আলিঙ্গন, অঙ্গের সীমান্ত প্রান্ত রবীন্দ্রনাথের দেহ চেতনাকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। আবেগী বর্ণনায় শরীরী বাস্তবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আমরা ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘বিজয়িনী’ কবিতায় রূপবতী রমণীর স্নান শেষের দৃশ্য দেখে নেবো-
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে, তারি শিখরে শিখরে
পুড়িল মধ্যাহ্নরৌদ্র-ললাটে অধরে
উড়ু- পরে কটিতটে স্তনাগ্রচুড়ায়
বাণ্ডযুগে, সিক্ত দেহে রেখায় রেখায়
ঝলকে ঝলকে।
কবির হৃদয় ক্যানভাসে নারীর শরীরের প্রতিটি ভাঁজ চোখ বন্ধ করলেই উপলব্ধি করা যায়। এ যেন রক্তে-মাংসে গড়া রমণীর চিরচেনা রূপ
‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাটকে আমরা দেখি অর্জুনের কাছে আত্মনিবেদন প্রসঙ্গে চিত্রাঙ্গদা বলেছেন…
কহিলাম, লহো, লহো, যাহা কিছু আছে
সব লহো জীবনবল্লভ। দুইবাণ্ড
দিলাম বাড়ায়ে। -চন্দ্র অস্ত গেল বনে,
অন্ধকারে কাঁপিল মোদিনী।
স্বর্গমর্ত দেশকাল দুঃখ সুখ জীবনমরণ
অচেতন হয়ে গেল অসহ্য পুলকে।
রবীন্দ্র নাথ নিপুণভাবে মিলনের চরম মুহূর্তের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এক কথায় প্রাণবন্ত। এ যেন চরিত্রের দাবি এবং স্বাভাবিক।
এরপর আমরা যদি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ভুবনে চোখ রাখি, সেখানেও দেখবো বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে নারীর শরীরী বাস্তবতার দৃষ্টান্ত মিলবে। নজরুল বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও মূলত রোমান্টিক ধারার কবি তিনি। ধূমকেতুর মতোই বাংলা সাহিত্যে যার আগমন। কালনাগের বিষের ধারক তিনি। জাহান্নামের আগুনে বসেও পুষ্পের হাসি হাসেন তিনি। যে ভৃগু ভগবানের বুকে পদচিহ্ন রাখতে দ্বিধা করেন না; সেই বিদ্রোহীকে চিনে নিতে আমাদের খানিকটা দ্বিধান্বিত হতে হয়। ‘বিদ্রেহী’ কবিতায় নজরুল যখন লিখেন-
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত-চুম্বন-চোর- কম্পন আমি থর-থর-থর- প্রথম পরশ কুমারীর।
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কনকন
আমি চির শিশু চির কিশোর
আমি যৌবন ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর।
এই সেই বিদ্রোহী, প্রিয়ার চাহনি দেখে কাতর হয়ে পরে, চুরি করে চুমু খেতে গিয়ে শরীরে শিহরণ জাগে। সে পল্লীবালার ভালোবাসায় ভীতু, তার বক্ষ বন্ধনী কিংবা শাড়ির আঁচল হতেও দ্বিধা নেই কবির। পরিপূর্ণ একজন বিদ্রোহী অন্তরাত্মার কাছে সমর্পিত শরীরী বাস্তবতা ‘বিদ্রোহী’কে নিমিষেই বানিয়ে ফেলে কোমল বিদ্রোহী।
“দোলন চাঁপা” কাব্যগ্রন্থে ‘পূজারিনী’ কবিতার উদ্ধৃতাংশে লক্ষ করি-
নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।
ইহাদের অতি লোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়
যাচে বহুজন।
শরীরী বাস্তবতা পুঁজি করে অভিজ্ঞতার স্ফুরণ ঘটতে দেখি কবিতায়। নারীকে কবি দেবী বলার পাশাপাশি বলতে দ্বিধা করেননি, নারী প্রচণ্ড লোভী। বহুগামী নারী; এরা একজনে তৃপ্ত নয় বলেই বহুজনের স্বাদ আস্বাদনের কথা বলা হয়েছে। ভোগ বিলাসের সামগ্রী হিসেবে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা দেখি নজরুলের “ছায়নট” কাব্য গন্থে-
তাপস কঠিন উমার গালে চুমার পিয়াস জাগে
বধূর বুকে মধুর আশা কোলে কুমার মাগে।
দেবীর আড়ালে একজন নারীর কামনা বাসনার ইঙ্গিতময়তা লক্ষ্য করার মতো। কামরসের আস্বাদন শেষে কোলে কুমার চায় নারী, কেননা মিলনেই যে পূর্ণতা। এমনি অজস্র কবিতায় নারীর শরীরী বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। আমরা যাকে মানসচক্ষু বলি সেই মানস চক্ষের আড়ালে প্রতিবিম্বিত চিত্রটি কেবলি অনুভব করার।
প্রসঙ্গক্রমে “সন্ধু হিন্দোল” কাব্যগ্রন্থের ‘অনামিকা’ কাব্যগ্রন্থের উদ্ধৃতাংশ দেখে নেয়া যাক-
যেদিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিলো আদি সৃষ্টি কাম
সেই দিন স্রষ্টাসাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম
আমি কাম, তুমি হলে রতি,
তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি।
সৃষ্টির শুরুতেই নর নারী একে অপরের পরিপূরক। নর আছে বলেই নারী, নারী আছে বলেই নর। শিল্প সাহিত্যে বরাবরই নারী যেনো রহস্যময়ী। নারীকে ঘিরেই আলো-আঁধারীর এক ধোঁয়াসা জগৎ তৈরি হয়ে আছে সেই শুরু থেকেই।
তারপরও বরাবরই নারীকে নিয়ে যে প্রশ্নটি বহুবার উত্থিত হয়েছে তা হলো- নারী কি কেবলি ভোগ বিলাসের সামগ্রী? পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীর বেড়ে ওঠা পরগাছার শিকড় মাটি স্পর্শ করে না বলেই ভিন্ন গাছকে অবলম্বন করে তার বেঁচে থাকা। শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটলেও স্বকীয়তা ও দৃঢ়তায় বরাবরই পরনির্ভরশীল।
বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব ‘নীহারঞ্জন রায় লিখেছেন-
“মধ্যযুগে দেখিতেছি দেবই হউন আর দেবীই হউন,
বাঙ্গালি যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে তাঁহাদের মর্তের ধুলায় নামাইয়া
পরিবার- বন্ধনের মধ্যে বাঁধিতে এবং ইহজগত সংসার- কল্পনার
মধ্যে জড়াইতে, হৃদয়াবেগের মধ্যে তাঁহাদের পাইতে ও ভোগ
করিতে, দূরে রাখিয়া শুধু পূজা নিবেদন করিতে নয়।”
[বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, আদিপর্ব / নীহারঞ্জন রায়/ বাঙালীর
হৃদয়াবেগ/ প্রাণধর্ম ও ইন্দ্রিয়ালুতা/পৃষ্ঠা ৭১৫]
বাংলা কবিতার বহুমাত্রিকতা বরাবরই আমাদের অভিভূত করে। বাংলা কবিতার অন্যান্য প্রকরণের যে বিশাল রত্নভাণ্ডার রয়েছে তার অধিকাংশই আমাদের অজানা। মেধা-মননে এবং আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানামাত্রিক তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা আমাদের কাব্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করবে।
বাংলা কবিতার এই যে দীর্ঘ পথচলা তা কখোনই কুসুমাস্তর্ঢু ছিলো না। বন্ধুর এ পথের বাঁকে বাঁকে ধর্ম- বর্ণ-জাত-গোষ্ঠীর উত্থান পতন, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়েছে আজকের পটভূমি। যুগে যুগে এ পটভূমি নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন কবি। কবিদের ভূমিকা অনেকটাই বৈজ্ঞানিকের মতো, উপাসকের মতো। কবি ভাবেন আগামীকালের কথা। স্বভাবতই কবির চিন্তা প্রকৃতি, আলো-আঁধারির খেলা, নৈসর্গিক পটভূমি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যে কতোটা উজ্জ্বল হতে পারে তারই দৃষ্টান্ত দেখবো“ঝরা পালক” কাব্যগ্রন্থের ‘দক্ষিণা’ কবিতায়-
এসেছে নাগর- যামিনীর আজ ডাগর রঙিন আঁখি
কুয়াশার দিনে কাঁচুলি বাঁধিয়া কুচ রেখেছিল ঢাকি
আজিকে কাঞ্চী যেতেছে খুলিয়া, মদ ঘুর্ণনে হায়
নিশীথের স্বেদ মীধুধারা আজ ক্ষরিছে দক্ষিণায়
রূপসী ধরণী বাসকসজ্জা রূপালি চাঁদের তলে
বালুর ফরাশে রাঙা উল্লাসে ঢেউয়ের আগুন জ্বলে!
[দক্ষিণা/ জীবনানন্দ দাশ]
এভাবেই আধুনিক কবিতার শরীরজুড়ে কবির কামনা ও বাসনার প্রলেপ ছড়িয়ে আছে। আধুনিক প্রসাধনে নারীকে সুসজ্জিত করার কুশিলবগণ কবিতার প্রচ্ছদে নারীর শরীরকে উপলব্ধি করেছেন বারবার। কবির চিন্তা চেতনার আধুনিকতার উজ্জ্বল আলোকরশ্মি প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের দেব দেবী নির্ভর সাহিত্যের সীমানা পেরিয়ে কবিতা উঠে এলো মানুষ ও মাটির কাছাকাছি। হৃদয়গত অনুভূতিকে ভেঙে চুরে কবিতার শরীর জুড়ে নারীর শরীরী বাস্তবতা প্রকট থেকে প্রকটতর হলো। বিভিন্ন রূপে এবং নান্দনিকভাবে নারী তাঁর উপস্থিতির জানান দিলো। আমরা আবারও ফিরে যাব জীবনানন্দের কবিতার কাছে।
জীবনানন্দ দাশ মূলত প্রকৃতি প্রেমী। কাব্যভাষা, স্বভাব, সুর ও কবিতার বিষয়বস্তু প্রকৃতি কেন্দ্রিক। প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাস জুড়ে অবাধ বিচরণ তাঁর। বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য যেভাবে বদলে দেয় প্রকৃতির জলরং কিংবা তৈল রং অথবা শাদা কালো, আলো আঁধারির পটভূমি ঠিক তেমনি জীবনানন্দের কবিতায় আমরা শরীরী বাস্তবতা উপলব্ধি করি-
যৌবনের সুরাপাত্রে গরল-মদির
ঢালোনি অধরে তব ধরা মোহিনীর
ঊর্দ্ধফনা মায়া ভুজঙ্গিনী
আসেনি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি
চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু
বিষবহ্নি ঢালোনিকো বাসনার বধূ
অন্তরের প্রাণপাত্রে তব
[ঝরাপালক/ কিশোরের প্রতি/ জীবনানন্দ দাশ]
এ প্রসঙ্গেআল মাহমুদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। আল মাহমুদের কবিতায় প্রধান বিষয় নারী। নারীর প্রেম, শরীরী আকর্ষণ দৈহিক মিলনের ইঙ্গিতময়তা তাঁর কবিতায় বিশেষ একটা জায়গা দখল করে আছে। অর্থৎ তাঁর কবিতায় নারীর প্রভাব ব্যাপক ও গভীর।
আল মাহমুদের কবিতায় নারী প্রসঙ্গে ড. ফজলুল হক তুহিন লিখেছেন-
“বাস্তব জগতের রক্ত মাংসের নারী আল মাহমুদের কবিতায় প্রধান রূপে বিবেচিত, তবে তাঁর নারী ভাবনার ক্রম পরিবর্তন লক্ষণীয়। স্পষ্টত কয়েকটি দিক থেকে তিনি নারীকে দেখেছেন; প্রথমত গার্হস্থ্য প্রেম ও যৌনসঙ্গি, দ্বিতীয়ত প্রকৃতির প্রতীকে।” [আল মাহমুদের কবিতা বিষয় ও শিল্পরূপ ড. ফজলুল হক তুহিন, পৃষ্ঠা ৯১]
প্রসঙ্গক্রমে আল মাহমুদের উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরছি-
স্পর্শ করো, পান করো, অলৌকিক অমৃতের ভাঁড়
কর্পুর মিশ্রিত এই ঘূর্ণিঝড় নিশ্বাসে নামাও
উষ্ণ মহাদেশে আজ ভস্ম হোক তোমার কৈশোর
অকস্মাৎ বেড়ে ওঠো, অকস্মাৎ
পূর্ণাঙ্গ পুরুষে
রূপান্তর ঘটাবার উৎসমুখ উন্মুক্ত আমার
শিথিল বন্ধনীসূত্র, কটিবন্ধ
কাঁচুলী কুন্তল।
[জুলেখার আহ্বান/ আল মাহমুদ]
কিংবা-
সুনীল চাদরে এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি।
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়,
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ লাক্ষ্যরসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধাঁয়
[সোনালি কাবিন/ ৩নং সনেট/ আল মাহমুদ]
কামরসে জর্জরিত কবি অষ্টাদশীকে এভাবেই শয্যাসঙ্গি হিসেবে পেতে চান। সময় বিশেষে রমণীর কাদাজলে না হয় উগোল মাছ তার স্বাদটুকু বুঝে নেবে। প্রতীকাশ্রয়ী বাক্যবিন্যাস নিমিষেই পাঠককে পৌঁছে দেয় একটা নির্দিষ্ট স্থানে। মিলনের মাঝে কবি অমৃতস্বাদ খুঁজে পান বলেই নির্দ্বিধায় বলতে পারেন ‘স্পর্শ করো, পান করো, অলৌকিক অমৃতের ভাঁড়’। আল মাহমুদের কবিতায় নারী তার শরীরী ভাঁজ খুলে দিলে উগোল মাছ তৃপ্ত হবে তার কাম লালসায়, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলা কবিতায় নারী ও নারীর শরীরী বাস্তবতা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কবির কলমে উঠে এসেছে। কবি বহুগামী না হয়েও একজন নারীর শরীর নিয়ে তৃপ্ত থাকতে চান। প্রসঙ্গক্রমে আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতার উদ্ধৃতাংশ দেখে নেবো একবার-
আজন্ম সৈরিণী তুই, একথা জানতে বাকি নেই
বন্ধুরা বলেছে ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো
সুন্দরীকে নাও, তবু তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, এবং সতত,
তোর ফোলা- ফোলা চোখ, কমলার কোষের মতো ঠোঁট
নিখুঁত উরুর স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নেয়
অন্য কোনো যুবতীর মুখ
কি করে ভাবতে পারি বল?
[আপন যৌবন বৈরী/ স্বৈরিণী/ আবু হেনা মোস্তফা কামাল]
কবি বহুগামী নন, তাই অন্যত্র স্বাদ আস্বাদনের জন্য কবিকে প্রলুব্ধ করলেও কবি বরাবরই তার প্রেয়সীর প্রতি আন্তরিক, অতএব প্রেয়সী ছাড়া ভিন্ন কোনো যুবতীর সাথে দৈহিক মিলনের চিন্তা কবির ভাবনার অতীত। নিখুঁত উরুর স্রোত কবিকে ভাসায়-ডোবায়।
দৈহিক মিলনের কথা তো কতো ভাবেই বলা যায়। নারীর শরীরের প্রতি ভাঁজে মুক্তো হিরক দ্যুতি কবিকে অস্বাভাবিক মাত্রায় আলোকিত করলেও মিলন প্রত্যাশি কবি নির্মলেন্দু গুণ বিনয়ের সাথে যা বলেন-
আমিতো বাৎসায়ন, আমাকে পড়ো,
আমাকে জড়িয়ে ধরো বুকে
উন্মিলিত স্তনগুচ্ছে, উরুর উত্থানে
স্বর্গসুখে সমুদ্রসঙ্গমে যাও ভেসে
তারপর চিনে নাও দুটি পাতা আর
একটি কুড়ির গভীর গোপন দেশে।
[নিশিকাব্য/ গোধুলি পর্ব ১১/ নির্মলেন্দু গুণ]
অখবা-
শুধু চোখে নয়, নখ দিয়ে নখ
চুল দিয়ে চুল, আঙ্গুলে আঙ্গুল
হাঁটু দিয়ে হাঁটু, উরু দিয়ে উরু,
আর এটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাও।
শুধু চোখে নয়, চোখে চোখে চোখ
বাহু দিয়ে বাহু, নাভি দিয়ে নাভি ;
[উল্টোরথ/ নির্মলেন্দু গুণ]
স্বর্গসুখে সমুদ্রসঙ্গমে ভেসে যাওয়ার জন্য কবি সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। মিলনের নেশায় পাগলপ্রায় কবি। দুটি পাতা ও একটি কুড়ির গভীর গোপন দেশে পৌঁছবার জন্য অপেক্ষমান কবির পাশাপাশি ক্ষণিকের জন্য হলেও পাঠক পৌঁছবার জন্য হলেও পাঠক পৌঁছে যায় ভিন্ন স¦াদের কাছে। চঞ্চল হয়ে উঠে পাঠক চিত্ত।
কিংবা গতানুগতিক নিয়ম মাফিক কলা-কৌশলে বিশ্বাসী নন কবি। ‘উল্টোরথ’ কবিতায় স্বভাবতই কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হতে শুনি-
চাবি দিয়ে তালা খোলা দেখিয়াছি
তালা দিয়ে খোল দেখি চাবি।
প্রতীকাশ্রয়ী বর্ণনায় বিপরীত লিঙ্গের নিবিড় পর্যবেক্ষণেরই বহিঃপ্রকাশ। নারীর শরীরী বাস্তবতার চিত্র যে কতভাবেই আঁকা যায় এ যেন তারই উদাহরণ।
পাশাপাশি বিবাহিত পুরুষের বেলা কবির দিক নির্দেশনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্ত্রীর প্রতি বিবাহিত পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে কবি স্পষ্টভাবে বলেন-
………মনে রেখো,
তোমার রাত্রি নেই, অন্ধকার বলে কিছু নেই।
বিবাহিত মানুষের কিছু নেই একমাত্র যত্রতত্র স্ত্রীশয্যা ছাড়া
তাতেই শয়ন করো, বাথরুমে, পূজোঘরে, পার্কে, হোটেলে
সন্তানের পাশ থেকে টেনে এনে ঠোঁটগুচ্ছে চুমু খাও তাকে।
[স্ত্রী/ নির্মলেন্দু গুণ]
ষাট দশকের কবিরা নারীর শরীর যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন, দেহ চেতনাকে যেভাবে সাহিত্যের উপজীব্য করে তুলেছেন তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে সাহিত্যের মানদণ্ডে তা কতোটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। কবিতায় নারীর শরীরী বাস্তবতার যে চিত্রায়ন (কবির কলমে) দৃশ্যমান তা অলীক কোনো কল্পনা প্রসূত নয়। বাস্তবের এ পিঠ আর ও পিঠ মাত্র। সহজ কথা সহজ করে বলতে পারেন বলেই তিনি কবি। এ প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার এর কবিতার দিকে খানিকটা নজর দেয়া যাক-
… যদি দেবে তবে তুমি সর্বস্ব রাখিও
শর্তহীন দেবে বলে। যা দেবার আদ্যেপান্ত দিও।
কামে ও যৌনতায় তার বেড়ে ওঠা। যেন ভিখারির
শেষ পট্রবস্ত্র খসে বালক-শোভন শিহরণে।
[শুভাকুসুম দুই ফর্মা/ স্নেহে যৌনাকাক্সক্ষা হয়/ ফরহাদ মজহার
কবির ভাষায় নারী সহজলভ্য পন্যসামগ্রীর মতো প্রতিনিয়ত পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থায় নিয়ম মাফিক তাঁর জীবন যাপন, বাজারের প্রচলিত পণ্যের মতোই নারীকে শর্তহীনভাবে পেতে চান কবি। চান পুরোটাই। কোনো খণ্ডাংশ বা ভগ্নাংশ নয়।
কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়-
তোমার স্তন তারা মাপছে ফিতা দিয়ে
তোমার কোমর তারা মাপছে ফিতা দিয়ে
তোমার উরু তারা মাপছে ফিতা দিয়ে
দাড়িপাল্লা ঝুলিয়ে ওজন করছে তোমাকে
তোমার দাঁত চুল নখ পরখ করে সাব্যস্ত করছে তোমার মূল্য।
[কর্তৃত্ব গ্রহণ করো নারী/ ফরহাদ মজহার]
বাস্তবতার নিরিখে কবি পুরুষের চতুরালি বরদাশত করতে পারেন না। কবি চিত্ত আহত, ক্ষত বিক্ষত। নারীর শরীরী বাস্তবতা কবির ভেতরে এক ধরনের রক্ত ক্ষরণের আভাস পাই।
কবি নারীকে রুখে দাঁড়াতে বলেন। বলেন কতৃত্ব গ্রহণ করার কথা। প্রচলিত পণ্যের মতো নারী বেচা কেনা হয়। সমাজে বার বার হাত বদল হয় নারী। ধর্ষিত নারীর বেদনাহত চিত্ত কবিকে কাঁদায়।
উপরে উল্লিখিত উদ্ধৃতাংশের পাশাপাশি “ত্রিভঙ্গের তিনটে জ্যামিতি” কাব্যগ্রন্থের ‘জাাতমাতারি’ কবিতাটির অংশ বিশেষ উল্লেখ করছি-
শুধু আমাকে নয়
সমস্ত পুরুষকে তুমি ক্ষমা কর
আমি আজ সমস্ত পুরুষের হয়ে তোমার ক্ষমা প্রার্থী।
[কতৃত্ব গ্রহণ কর নারী/ ফরহাদ মজহার]উপরে উরিল্লখিত উদ্ধৃতাংশের পাশাপাশি ‘ত্রিভঙ্গের তিনটে জ্যামিতি’ কাব্যগ্রন্থের ‘জাতমাতারি’ কবিতাটির অংশ বিশেষ।
এখন তো তোর গাল ছুঁয়েছি
চোখ ছুঁয়েছি, নাক ছুঁয়েছি
এখন তো তোর মাজার মজায়
খোদ আড়াতে দিল থুয়েছি।
কবি যেমন নারীকে সহজলভ্য মেনে নিতে পারেন না, তেমনি ভোগ বিলাসের জন্য নারী অপরিহার্য, এ বিষয়ে তার কোনো দ্বিমত নেই বলেই ঠোঁট, গাল, চোখ ছুঁয়ে কাম লালসায় নারীকে জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট কেননা মাজার মজায় কবি হৃদয় সমর্পণ করেছেন।
……………………………………….
পয়দা করতে না পারলে তুই
পা ফাঁক করে কী কাম করবি!
মাগীর মতোন সময় চটকে
না ফেনালে কি বীজ ফেলবি!
মিলনের আতিশয়্যে কবি খিস্তি খিউর করেই থামেননি, নারীকে পরিপূর্ণ তৈরি করার জন্য গাল মন্দ করেছেন, ধমকে দিয়েছেন মিলনের পূর্ণ স্বাদ আস্বাদনের জন্য।
দৈহিক মিলনের রোমাঞ্চ আর নারীর অন্তর রহস্যকে উসকে দেয়ার প্রবণতা কবিকে পেয়ে বসেছে। সম্ভোগের যাবতীয় আয়োজন শেষে মিলন প্রত্যাশি কবির অনেকটা পাঁচমিশালি অভিজ্ঞতায় নিজেকে আরো একবার তৈরি করে নেয়া। নিজের দম্ভ প্রকাশ করা-
আমার পেশী মেহগনির
আমার নুনু বনের কাঠের
মতোন কাট্রা, আমার চামড়া
শিশির তাতা ভেজা মাঠের
মতোন মেটে। আমার জিহ্বা
চাটবে তোকে যেমন ষাঁড়ে
চাটে গাভীর গেরস্থালি।
[জাতমাতারি/ ফরহাদ মজহার]
কবি তো সমাজেই বাস করেন তিনি তো সমাজেরই একজন; তার ভাব, কল্পনা, চিন্তা চেতনার প্রকাশ সমাজকে কেন্দ্র করেই এই সকল কাম- উত্তেজনা, প্রেম-বিরহ সবই কবির একান্ত নিজস্ব। কবির কল্পনায় লিখনির মাঝে নারী উপমা হিসেবে এসেছে। এসেছে শরীরী বাস্তবতার কথাও।
“কবিতা সৌন্দর্যের বিরামহীন বিস্তার, ইন্দ্রিয়ের অনন্ত আলোড়ন, জীবাশ্মের মতো নির্মোহ মহর্ষির প্রাজ্ঞতা, ধ্যানের অবিচল উৎসরণ, জীবনের আদিম উচ্ছ্বল উৎসব, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্পের নির্বাণহীন অঙ্গার।”- হুমায়ুন আজাদ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় এসব কথাই লিখেছিলেন। কবি কখনই বাস্তব বিবর্জিত নয়। বাস্তবের রীতি, নীতি, প্রকৃতি, মাটি ও মানুষ এবং নারী ; অনিবার্য ভাবেই নারীর শরীর কবির মানসপটে যে ক্যনভাস নির্মাণ করে তারই বহির্প্রকাশ দেখি কবিতায়।
হুমায়ুন আজাদের কবিতায় ক্রমশ নারীর শরীরী বাস্তবতা কবিকে নিয়ে যায় ভিন্নলোকে। যৌনমিলনের চরম শিখরে পৌঁছবার লক্ষ্যে কবি নিমিষেই কলের পুতুল হয়ে যান। পৃথিবীর নান্দনিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলবো নাকি বলবো কবিতা জীবনের কতো কাছাকাছি-
“পেরোনের কিছু নেই” কাব্যগ্রন্থে ‘ই-শ! ই-শ! এ-ই, আ-হ, এইখানে প্রিয়।’ কবিতায় হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন-
ই-শ! ই-শ! আহ, এইখানে প্রিয়! এইখানে রাখো
জিভদের! আহ! মরে যাচ্ছি! চোষ, একটুকু ধীরে
আ-হ! ডান চাঁদে ঠোট রেখে চিরকাল থাকো
পান করো, খাও, গেলো, শুষে নাও, ভেঙে, ফেড়ে- ছিঁড়ে!
… … …. ….. ….. …… …… ……..
আমার মুঠোতে দাও রাজদণ্ড! দাও ধরি! বন্য দেবতা
এতো দৃঢ়, পেশল! শক্তিমান! উচ্চশির! দাও তারে মুখগহ্বরে!
কবি এখানে প্রেয়সির হাতের পুতুল, যেমন নাচাও তেমনি নাচতে বাধ্য সে। নইলে রসস্বাদনের স্বর্গসুখ খেকে বঞ্চিত হবে। কষ্ট হবে কামদেবতার। প্রেয়সির কঠিনতর নির্দেশ উপেক্ষা করার সাধ্য কি তার-
…………………………….শিউলি বোঁটায়
রাখো ব্যাঘ্রজিভ, কমলোষ্ঠে, চোষো ভাঙ্গো! ঘন মধু ঝরে
আহ! মধু খাও প্রিয়! মরে যাচ্ছি! ফোঁটায় ফোঁটায়
ঝরে যাচ্ছি, ঢোকো, মধুময় চাকের ভেতরে!
ঢো-কো! আ-রো গভীর পাতালে! ই-শ বিদ্ধ খনন করো
আহ! কে ঢুকছে! পশুদেব! কবিতা! ধীরে ধীরে ধীরে,
এ-ই-বা-র দ্রুত প্রিয় মরে যাচ্ছি, ঢোকো, দুই হাতে ধরো
ভেঙে যা-চ্ছি! মরে যাচ্ছি, গলে যাচ্ছি মৃত্যুর গভীরে।
শয়নে-স্বপনে-কল্পনায় কবি নারীকে সাজায়। কবিতার শরীরে নারী মূল্য পায় কবির কাব্য ভাষায়। এ প্রসঙ্গে ষাটের অন্যতম কবি হুমায়ুন আজাদের কাব্য ভুবনে ঘুরে আসি আরও একবার-
এভাবে নয়? আরো মৃদু? আস্তে আস্তে? খুব ধীরে ধীরে?
জীভকে সাপের মতো পিচ্ছিল মুখের গভীরে
টুকরো পেঁচিয়ে ধরবো জিভ পাকে পাকে? যে রকম বনে
কোবরা পেঁচিয়ে থাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে
গ্রীবায়? চিবুকে? ওষ্ঠে? অধরে? চোখের পাতায়? দুই টোলে
রত হবো? ভেজা কর্মরত হবো? সিক্ত ডান বাহুমূলে?
যাবো চাঁদ থেকে চাঁদে লাল বৃত্তে ফোটা?
চষবো শুষবো প্রস্ফুটিত রক্তপদ্ম, তার থরো থরো বোটা?
পাঠক এখানে আর কোনো কিছুই অব্যক্ত রইলো না। মিলনের পূর্ব মুহূর্তে কবি তার প্রেমাস্পদের কাছ থেকে মিলনের প্রতিটি বিষয়ে খুঁটি-নাটি তামিল নিয়েছেন! আথবা
যাবতীয় সুখানুভূতি শিখে নেয়ার ব্রত নিয়েছেন? কবি কি আনাড়ির মতো প্রতিটি পদক্ষেপে পূর্বানুমতি নিতে তৎপর? বাৎসায়নের কাম লালসার সূত্রগুলো জেনেও না জানার ভাণ করা? সন্দেহ নেই মিলনের চরম মুহূর্তে এক প্রাণবন্ত দৃশ্য এঁকেছেন কবি। দৃশ্যটি এতো উজ্জ্বল ও প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ যা স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের কাছে ভোগ বিলাসের স্বাদ আহরণের ভিন্ন এক পটভূমি-
আরো নিচে ঝরণাতলে? যেখানে জমেছে মধু? শিউলি বোটায়
কমলোষ্ঠে ঝরছে ঘন মধু, গলে গলে ফোঁটায় ফোঁটায়?
ধীর স্রোত হয়ে? চুঁইয়ে চুঁইয়ে? যেইখানে আঙ্গুরের খনি?
কষ্ট করে পান করে যাবো সারারাত বন্য মধুমনি?
প্রবেশ করবো? দৃঢ়? প্রচণ্ড? সুন্দর? এখন ফেলবো নোঙ্গঁর?
ভেঙ্গে পড়ছে দুই পার? জ্যোস্নায় পদ্মবনে ঢুকছে বর্বর?
দ্রুত? এখন আবার ধী-রে? আস্তে? খুব ধীরে ধী-রে?
আহ্্ আহ্ পুলকিত ঘুম নামে পুষ্প আর স্বর্ণখনি ঘিরে?
[এই ভাবে নয়? হুমায়ুন আজাদ]
সৌন্দর্য এতো মোহময় ও স্বর্গীয় যা পাঠকের বাড়তি লাভ। লেখক সুকৌশলে এ উপভোগের একটা সুযোগ করে দেন। কবিতার পটভূমি হয় বিস্তৃত। “স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে কতোটা এই মানুষ? কতোগুলো এই কবিতা? এই যে কবিতা আমাদের এতোসব প্রণোদনা দেয়, আমাদের চিত্তকে উজ্জিবিত করে এবং রস বিচ্ছুরণে তৃপ্ত করে এর কারণ কী? তা হলো এর সুচারু শব্দচয়নে গঠিত সুন্দর ভাাষা, তীব্র আবেগ ও ভাব, মনোহর চিত্রকল্প, অলঙ্কার এবং সর্বেপরি ছন্দ। এর প্রতিটি উপাদানই গুরুত্তপূর্ণ, কোনোটার ঘাটতি হলে পাঠকের রসস্বাদনেও ঘাটতি থেকে যায়। সব ধরণের কবিতাতেই ছন্দ থাকে। এমনকি গদ্য কবিতায়ও ছন্দের আভাস সৃষ্টি হয়।” [নতুন এক মাত্রা/ সম্পাদক আল মুজাহিদী/ তৃতীয় বর্ষ-প্রথম সংখ্যা/ কবিতা ছন্দ ও ছন্দাতীত/আবুল কাইয়ুম/ পৃষ্ঠা-৩৩]
বাংলা নারী ও নারীর শরীরী বাস্তবতা সত্তর দশকের কবিদের কবিতায় অনেকটা আলো আঁধারীর মতো। সচেতনভাবেই খোলা মেলা ভাবটা এড়িয়ে চলার প্রবণতা লক্ষ করার যায়।
সত্তরের কবি মুজিবুল হক কবীরের ‘শরীরের ভাষা’ কবিতার উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরছি-
১.শরীরের ভাষা বুঝিনা বুঝি
তোমাকে তো পাই প্রত্ন কলায়
তোমাকে ঋদ্ধ করি বারবার
অপ্রতিরোধ্য উষ্ণ ফলায়।
[শরীরের ভাষা/ মুজিবুল হক কবীর]
আবিদ আজাদের ‘ভয়’ কবিতার উদ্ধৃতাংশ-
২. আমার হাতের মুঠোয় ভরে দিচ্ছ কেনো
গোলাকার বরফের কোমল আগুন
তোমার নাকের কেশরের তাপে আমি পুড়ে যাবো…পুড়ে যাবো
খালাম্মা আমার ভারী ভয় করে, আমাকে নামিয়ে রাখো
মা দেখলে বকবে না?
[ঘাসের ঘটনা/ ভয়/ আবিদ আজাদ]
কাম লালসায় তাড়িত কবি সম্পর্কের নৈতিকতা ভুলে যান। সম্পর্কের চাইতে শরীরী মিলনকে নিয়ে যান রস আস্বাদনের স্বর্ণমন্দিরে। এখানে শরীর কবিকে পুরোপুরি গ্রাস করলেও দুঃখ নেই। কবি পুড়ছেন, পুড়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পেছনে শঙ্কা আর ভয় পেয়ে বসেছে তাঁকে; অনৈতিক ফলাফলের মিলন শোভন নয়, পেছনে মা যদি দেখে ফেলে!
কবি জাফরুল আহসানের কবিতায় দেখি-
৩.খেলার ছলে খেলবে বলে জড়িয়ে নিলে যেই
তোমার মাঝে কালনাগটি তুলছে ফনা সেই,
ভেজা কপাট খুলতে গিয়ে করলে তুমি একি!
এক নিমিষে কাঁদাজলের সফেদ ফেনা সে কি?
[প্রেমের কবিতা/ খেলা/ জাফরুল আহসান]
কবি আতাহার খান তাঁর কবিতায় যেভাবে লিখেছেন-
৪.এভাবে নয় ওভাবে নয় কী ভাবে চাও তবে?
জড়িয়ে নিই নগ্ন দেহ, ছড়িয়ে দিই দাহ,
হবেই হবে স্নায়ু সুখের, গাঢ় বৃষ্টি হবে
ওলট পালট রক্তে জাগে আনন্দ প্রবাহ।
[শিল্পকর্ম/ আতাহার খান]
কবি জাহাঙ্গির ফিরোজ তাঁর কবিতায় নারীকে যে ভাবে এঁকেছেন-
৫.ধীরে ধীরে নগ্ন হয়ে যাও
ক্লান্ত তোমার শরীর থেকে খসে পড়ে পরিচ্ছদ
নগ্নতা চাঁদের মতন
উজ্জ্বল কুট্টিমে গলে গলে পড়ে রেশমের রাত্রিবাস
তুমি সেই নারী, আদিম উপমা,
[বদ্ধমাতাল রোদে/ রাত্রিবাস/ জাহাঙ্গির ফিরোজ]
“কবিতা কার্ড” ‘এ কোথায় পালাবে?’ কবিতায় কবি হাসান হাফিজ বলেছেন-
৬. আমি ভ্রষ্ট বুভুক্ষ মাতাল
তোমার লাবণ্য স্তন
কটি গ্রীবা তলপেট
উরু পিঠ মঞ্জুল বদ্বীপ
এভাবেই জীবনের
অতৃপ্তি ও আক্রোশ মেটাবো।
উপরে উল্লিখিত কবিতগুলোর উদ্ধৃতাংশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নারীর শরীরী বাস্তবতার কষাঘাতে কবি পর্যুদস্ত হলেও সরাসরি কিছুই না বললেও বুঝে নেয়া যায় মিলনের আতিশয্য প্রত্যেকের কবিতার অন্তরালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সত্তর দশকের কবিদের কবিতায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ, হতাশা, প্রাপ্তি ও পাওয়া না পাওয়ার বেদনা কবিতার শরীর নির্মাণে মূল উপাদান হিসেবে উঠে এসেছে। তবে নারীর শরীরী বাস্তবতার চিত্র যে সব কবিতায় দৃশ্যমান তা অনেটাই প্রতীকাশ্রয়ী। আলো আঁধারির মতো। ষাটের দশকের কবিদের মতো এতোটা খোলামেলা নয়। বাংলা কবিতায় নারী ও নারীর শরীরী বাস্তবতা প্রসঙ্গে আমরা বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকে সত্তর দশকের কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরেছি। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে কবির কাব্যভাষা ও বিষয়বস্তু কখনো কখনো অশ্লীলতা, যৌনতা ও নগ্নতার দোষে দুষ্ট বলে মনে হয়েছে, তবে তাতে তার সাহিত্যমূল্য ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করার কিছু নেই। যুগে যুগে কবির কলমে বিভিন্নরূপে নারীর শরীরী বাস্তবতা উঠে এসেছে কখনো সরাসরি কখনোবা প্রতীকাশ্রয়ী হয়ে। আবার কখনোবা চিত্রকল্প কিংবা দৃশ্যকল্প কাব্যভাষায় যুগিয়েছে প্রাণপ্রাচুর্য।
কবিতা আমাদের উজ্জিবিত করে, প্রণবন্ত করে, করে আবেগাপ্লুত কবি কবিতার বর্ণনায়, তার প্রবহমান স্রোতধারায় আর তার বিষয় বস্তুতে আকৃষ্ট করে পাঠক হৃদয়। কবিতা হয়ে ওঠে জীবনের কাছাকাছি।
সহায়ক গ্রন্থ :
১ সাহিত্য সন্দর্শন/ শ্রীশচন্দ্র দাশ/ পৃষ্ঠা ১
২. লাল নীল দীপাবলি/ হুমায়ুন আজাদ
৩. চর্যাপদ/ মাহবুবুল আলম
৪.সাহিত্যর ইতিহাস আদি পর্ব/ নীহারঞ্জন রায়
৫.বাংলা একাডেমির নিবেদন/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/ “অঙ্গের সীমান্ত প্রান্তে”
৬.রবীন্দ্র সাহিত্যে শরীরী বাস্তবতা/ দেবী মুখোপাধ্যায়
৭.বাংলা কবিতার নানা অনুষঙ্গ/ জাফরুল আহসান