বুদ্ধদেব বসু সান্নিধ্যে: মাহমুদ শাহ কোরেশী


১৯৬১ সালে প্যারিসের সর্বনে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বক্তৃতা উপলক্ষে এসে বুদ্ধদেব বসুর যে অভিজ্ঞতা তা তিনি মাত্র কয়েকটি পঙক্তিতে প্রকাশ করেছেন-

“গত দুই রাত্রি প্যারিসে প্রায় নিদ্রাহীন

কাটিয়েছি, সেখানে একটি চমৎকার দল

জুটেছিলো আমাদের- কলকাতা বাসিনী

বন্ধুপত্নী, দেশত্যাগী ভবঘুরে ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ,

পূর্ব পাকিস্তানি বাংলা সাহিত্য প্রেমিক,

শেষোক্ত দুজনের বিদেশিনী বান্ধবীরা- এই

যোগাযোগের ফলে এবং জুন মাসের রেশম

কোমল বাতাসের উৎসাহে। কাফেতে ঘুরে-

ঘুরে রাত্রিযাপন না করা অসম্ভব হয়েছিল।

মনে হয়েছিলো সারা প্যারিসই কাফেতে বসে

আছে, কেউ ঘুমোচ্ছে না। আড্ডার এই

রমনীয় রাজধানীতে ঘুম জিনিশটাকে মনে

হয় নিতান্তই সময়ের অপব্যয়।”

[বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধসমগ্র ২; পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পৃষ্ঠা ৪১৩; যথাক্রমে রাজেশ্বরী দত্ত, দেবেন ভট্টাচার্য বোস ও মাহমুদ শাহ কোরেশীর কথা বলেছেন। প্রতিভা বসু তাঁর গ্রন্থেও বিস্তারিত লিখেছেন]

এই বিখ্যাত সাহিত্যিক দশকীয় সঙ্গে পরবর্তী ৩/৪ বার ঘোরাফেরা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সঙ্গে ছিলেন দেবেন ভট্টাচার্য ও তাঁর প্রথম স্ত্রী বিরগিট। এক পর্যায়ে দুই সন্ধ্যায় সহযাত্রী হলেন স্বনামখ্যাত গায়িকা রাজেশ্বরী দত্ত। এতকাল পর এত কথা মনে নেই, তবে আমি বিমুগ্ধ চিত্তে তাঁদের স্মৃতি দীর্ঘকাল লালন করেছি। বুদ্ধদেবের অনুমতিক্রমে তাঁর ঠিকানায় পরে আমি দুখানা চিঠি লিখলামÑ যার জবাব এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৬৫ সালের আগস্টে আমি দু’মাসের জন্য স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে কলকাতা হয়ে দিল্লিতে প্যারিসের মিশন ধরতে যাই। তখন একটা দিনের বেশির ভাগ সময় মধ্যাহ্ন ভোজসহ বুদ্ধদেব পরিবারের সঙ্গে আমার ২০২ রাশবিহারী এভিনিউতে কাটে। তাঁর লেখা ‘বোদলেয়ার’ গ্রন্থটির কোনোকপি না পেয়ে প্রতিভা বসুর বইটি দুজনে মিলে আমাকে উপহার দেন।

এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ কাউন্সিলে আমি বুদ্ধদেব বসুর ইংরেজি কবিতার উপর একটি বক্তব্য শুনতে যাই। সেখানে আমাদের প্রখ্যাত শিল্পপতি এ. কে. খান সাহেবের সাক্ষাৎ পাই। পরে কয়েকবার ফোনে তার সঙ্গে আলাপ হয় কিছু। কিন্তু তাদের এলাকা নকসাল অধ্যূষিত বিধায় ওদিকে পা বাড়াইনি। দুর্ভাগ্যবশত, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আমার আর সাক্ষাৎ হয়নি তবে তাঁর সঙ্গে এর আগে চট্টগ্রাম থেকে দু’বার পত্রলেখা হয়েছিল। আমি ‘ফরাশি প্রসূন’ নাম দিয়ে একটি অনুবাদ পত্রিকা বের করবার কথা লিখলে তিনি আমাকে শুধু ‘প্রসূন’ নাম দিয়ে অনুবাদের ক্ষেত্রে উন্মোচিত রাখার পরামর্শ দেন। দ্বিতীয় পত্র ছিলো আমার বিয়ের নিমন্ত্রণের জবাব। তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে বিলেতের একটি ঠিকানা পাঠাতে লেখেন যাতে আমাকে কয়েকটি বই উপহার পাঠাতে পারেন। কিন্তু দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়াতে আমি আর কোনো চিঠি তাঁকে লিখিনি। তবে “কোনো নবদম্পতিকে চট্টগ্রাম” নামে আমাদের উপর দেশ পত্রিকায় এশটি কবিতা ছাপিয়ে ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের বহু পর আমি তাঁদের নিজ বাড়িতে ১৯৭৯ সালে এবং পরবর্তীকালে আরো একবার প্রতিভা বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। এ সময় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার রেকর্ড করি। আর দ্বিতীয়বার চমৎকারভাবে আপ্যায়িত হই। দীর্ঘ সময় কাটে আলাপচারিতায়।

আজ বহুদিন পর আমার পরম শ্রদ্ধার ও আদরের দাদা-বৌদির কথা স্মরণ করছি- তাদের সার্থক সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে গর্ব অনুভব করি। কেননা দুজনেই ছিলেন আমাদের এলাকার বাঙালি।

বু.ব.-র একটি চিঠি

(মাহমুদ শাহ কোরেশীকে)

প্রীতিভাজনেষু,

আপনি ইতিমধ্যে মার্কিন দেশ ঘুরে এলেন শুনে সুখী হয়েছি। আমার আমেরিকাতে বেশ ভালোই লাগেÑ সেটিই একমাত্র প্রতীচ্য দেশ যেখানে আমি বসবাস করেছি, সেখানে যে-রকম বন্ধুতা পেয়েছি তারই জন্য দেশটা আমার প্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার ছাত্রী ঝর্না বসু আবার প্যারিসে যাচ্ছেন। তাঁর কাছে আমার বোদলেয়ার অনুবাদ হয়তো পড়ে নিতে পরাবেন। স্থানীয় কোনো লাইব্রেরিতে কিবইটি নেই?

সর্বন থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বইটি যথাসময়ে পেয়েছিলাম। ওঁরা কিন্তু খুব একটা তথ্যগত ভুল করেছেন- ঐ প্রবন্ধটি আমি তো সর্বনে পড়িনি এবং সর্বনে প্রদত্ত মৌখিক বক্তৃতার সঙ্গে ওর কোনো সম্বন্ধও নেই। আমি সেবার দেশে ফেরার পরে আমার উপর যে-তুমুল আক্রমণ চলেছিলো তার মূলে ছিলো ঠিক এই ভুল ধারণা। কোনো এক সুযোগে কর্তৃপক্ষকে এই কথাটা জানিয়ে দেবেন?

খব চবঃরঃ চৎরহপব বাংলায় অনুবাদ করেছেন অরুণ মিত্র- সেটি “রংমশালে” ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিলো, বই বেরিয়েছে কিনা জানিনা। আপনি ফরাশি সাহিত্যেও প্রধান গ্রন্থগুলির অনুবাদের চেষ্টা করুন না। রুশোর কনফেশন্স, ফ্লোবেয়র, স্তাঁদাল, বালজাক যা আপনার বেশি ভালো লাগে। বা আরো আগের লিসকো? কাতোব্রিয়াঁর কিছু অনুবাদ হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব খুশি হই। কেননা, এঁর বই ইংরেজিতে দুষ্প্রাপ্য।

গোচিয়ে তাঁর Mile, de, Maupin ও যে ভূমিকা লিখেছিলেন, তার একটি সম্পূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন বাংলা অনুবাদ বিশেষ প্রয়োজনীয়। আপনি এটা করলে বাংলা সাহিত্যের উপকার হবে।

দেশে ফেরার পথে কলকাতায় কয়েকদিন কাটিয়ে গেলে আপনার ভালো লাগবে, আশা করি। দেবেন ও বির্গিটকে আমাদের শুভেচ্ছা জানাবেন। আমরা দুজনে আপনাকে প্রীতি জানাচ্ছি।

বুদ্ধদেব বসু