গুচ্ছ কবিতা: বঙ্গ রাখাল


আমি বোধ হয় নষ্ট হয়ে যাচ্ছি

পাতা ঝরা এক বকুল তলে দাঁড়িয়ে
বন্ধুকে মনে পড়ে শুক্লাক্ষণে
বন্ধু মানে কী জীবননদীর টলমল জল
নাকি নদী শুকিয়ে চৌচির হওয়া তীর
আমার শৈশবের বেলেজোসনার রাত
জোনাকী জীবনের হেয়ালিময় সকাল
সূর্য দীঘির টোপাপানার দেহ নৃত্য আর
মায়ের কানমলা গান…

মায়ের ভয়, আমি কোনদিন না জানি নষ্ট হয়ে যায়
যে দিন নষ্ট হয়ে যাবো
সেদিন বেদনার নদী বেয়ে আসবে না পালতোলা নৌকা
ধানের বিস্তৃত ক্ষেত বেয়ে আসবে না রাখালী হলুদ
আর আলতা রাঙা পায়ের দুধসাদা বালিকা…

আমি তো কবি নয়
নয় কোন বালিকার কোমর ছোঁয়া বিছা
আমি ক্ষয়, নষ্ট, শ্বেত পাথর
আর চড়ুই পাখির মাঠের উড়ে যাওয়া বিষণ্ন বাতাস…

 

শূন্যতা

কালের নৌকায় তেপান্তরের হতাশাক্লিষ্ট নওজোয়ান
শূন্যতার হাতে রেখে হাত পথচলা দিগন্ত
পায়ের নিচের মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে ওরা কংক্রিটের
লাল-নীল মিশ্রণ।

কাগজের ঠুংগায় জমেছে জীবনের জরাজীর্ণ এক ব্যর্থ ডাস্টবিন।

ন্যায়শালায় জমা হলো প্রণয়ের ব্যর্থসুর
কৌশলে বেঁচে যাওয়া সময়ের হাতে
এক শূন্যতার মহাশূন্য।

অচেনা এক বেদনার একতারা বাজে নিরন্তর
কংসমামাদের শোষণে চাপড়ে ধরে বুক
শূন্যতার এক হাত দেখা দেখিতে হাত বাড়িয়ে দেয়
দিগন্তে চেয়ে থাকা এক মহাশূন্য দিকচক্রবাল।

গোলাপ মূলত সংকেত তিলক

পূর্বের কথা মনে রেখে লাভ কি? হারিয়ে গেছে দিন-
ঘুমের ঘোরে যে বলেছিলে-কাপা কাপা ঠোঁটে
উল্টো বলতে পারতে কিংবা সত্যতা
না বলোনি… নিজেকে গুটিয়ে গিয়েছো ভুলে
বিষ্যুতবার হলেও রাস্তায় হেঁটে চলে গৃহস্তমশাই
দিন মাস ক্ষণ জানে না বিপদ…

কথাছিল ভূশয্যায়- রজনীগন্ধ্যা রেখে
দুজন সংসার সাজাব-রাস্তায়
মুখপানে বসে আঁকব তোমার মুখচ্ছবি
এটাঁই শেষকথা নয়…

ইশকুলে বাল্যবেলা- মধ্যবর্তী জীবনের পক্কতা
এনেও কী নিদারুণ কষ্টে-সাজাব তোমায়
কফিনে মোড়ানো যে আকাশ
সেটাও তো তোমারি ভুলে আঁকা হল
গড়িয়ে পড়ল জল…খানিক রেগে গম্ভীর…
নীলচোখে নীলিমা তোমাকে দেখি
পূর্বের হাওয়া শীতল হলেই
উড়ে যাই পরিযাযী পাখি…

এখন আকাশ চিনে- চিনে দূরের পথ
নিজের ঘরে, ফুটপথে কিংবা ইস্টিশনে
যে দাঁড়িয়ে পিছনে ঠেলেছে সময়
সেও তখন স্মৃতির ভিতরে নিজেকে খোঁজে
নদী সাঁতরে নিজেকে আবিষ্কারের অদম্য আশায়…

একটি সংসার ক্রমশ বড় হচ্ছে…
অস্পষ্টতায় ভরে যাচ্ছে জীবনের অধিকাংশ সময়
কাছের মানুষ দূরে দূরে থাকে
ধীরে ধীরে জীবনের অপরাহ্নেবেলায়
আমি ক্লান্ত পথিক…কপালে আঁকি সংকেত তিলক…

কান্তি এক মরিচীকার নাম-ডুবিয়ে দেয় জীবন
বুকের ভিতর সমাগত অস্ত্রসজ্জায় প্রতীকিফলা
ঈশ্বরের নামেও যুদ্ধ চলে- গোলাপ একটি ধারণা মাত্র…

পদ্ম

বাইরে প্রজ্জ্বলিত অন্ধকারে জ্বলে যাচ্ছে জীবনের
রং…ফিকে হয়ে আসছে জীবনলিপির প্রতিটি
পাতা- দূর স্টেশনে অপরিচিত মুখে-পরিচিত
আভা। কতদিন দেখেনি তোমায় প্রিয়ফুল…লিখে
রাখো ক্ষয়ে যাওয়া তারুণ্য-খেলে যাওয়া স্মৃতিময়
মূহুর্ত- হঠাৎ বিভীষিকায় পতিত হওয়া তোমার
দেহজ দহলিতে ঠাঁই পাওয়া এই আমি; এখনও
অন্ধকার করিডোরে লিখে রাখি নাম-পদ্ম।

অন্ধকার ও বধির

সহজেই হারিয়েযেতে পারতাম- তোমাদের ছেড়ে
দূরে অথবা কাছে…জীবন জীবনের গভীরে রেখে
হাসিচ্ছলে বলতে পারি-
প্রিয়তীর চেয়ে আমিও বেশ আছি ভাল…

একটি বাড়ির জীবন্ত কান্নায়-ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত
চুমুকে চুমুকে তুমি পান করো তা- আমি
জাদুবিশ্বাসে পারদর্শি; তুমি হলে বেদনার বুকমন্দিরে অমৃতসুখ-
আর স্মৃতিময় প্রিয়তমার উলকি আঁকা স্তন…

নিশ্চয় জানো তুমি- রক্ত একক যন্ত্রণা নয়
গাছের শাখে লুকানো থাকে ভালত্বর অন্তরালে কষ্ট
ঝিনুকের শরীরও লুকিয়ে রাখে অর্ধছেড়া- নুনগন্ধী ভুলে থাকা অভিমান…

স্বপ্ন বিচ্ছিন্ন লোকালয় থেকে দূরে- বিষকামড়ে কাপলো নদী
নিরবধি দীর্ঘতর দীঘির পাড়ে- অবারিত মেঘাচ্ছন্ন চোখে- আমি
তোমার রাতজাগা কান্না ছড়িয়ে দেই পৃথিবী জুড়ে।

এই আকুতি লজ্জার-এই আকুতি বেদনার;
কোথাও নেই- চেনামুখ
একদিন এই চিরচেনা মুখও মিলিয়ে যায়-
তেপান্তরের হাওয়ায়
চেতনার ওপারে অচেনা নদী- চারিপাশ অন্ধকার আমিও বধির…