গুচ্ছ কবিতা: তাসনীম মাহমুদ


আচরকাচরি বৃষ্টি

সৈনিকের জীবন হলে প্রতিটি বারুদের
গন্ধকে আমি আলাদা করে চিনে নিতে পারতাম-
স্মোকার হলে, পুড়ে যাওয়া ছাঁই দেখে
বলে দিতাম ব্র্যান্ড নেইম। যদি ঘাস ফড়িং হতাম’
শিশিরে জানিয়ে দিতাম কুয়াশার ভালোবাসা।
জোনাই হলে বলতে পারতাম অমাবস্যায়
অন্ধকারে রঙিন দ্যুতির রোমাঞ্চকর প্রেমের গল্প।
যদি হতাম পাফিনের ঠোঁট বাতাসের হৃদয় ঠুকরে
বলে দিতাম শূন্যের সীমানা আর
রাজনীতিবিদ হলে বলতাম: ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কেমন হয়’!

আমি তো ফুল নই যে সৌরভের রহস্য বলে দেবো
আমি তো মৌমাছি নই যে চাকের ঘর বুনে দেবো।

আমি বৃষ্টি বিলাস; বলে দিতে পারি
ঝরে পড়া প্রতিটি ফোঁটার টুপটাপ শব্দের
আকুলিবিকুলি আচরকাচরি আর চিনে নিতে পারি
প্রতিটি ফোঁটায় প্রতিটি ফোঁটার মিলে যাওয়া জীবনের বিবিধ গান!

ইচ্ছে ডানা

যে জীবন প্রজাপতির রঙের মতো
যে জীবন জোনাকির আলোর মতো
যে জীবন লাফ ফড়িঙের ডানার মতো
আহা! আমারও সাধ হয় তাদের মতো।

যে নদী বয়ে চলে নিরবধি
যে পাখি গায় গান আনমনে
যে ফুল কিশলয় আনে পৃথিবীর
তারা কত অনিন্দ্য, সুন্দর, নিঃস্বার্থ।

আহা! আমারও যে ইচ্ছে হয় বৃষ্টি হবো।
আহা! আমারও যে ইচ্ছে হয় নিশঙ্ক হবো।

শিশির যেভাবে ঝরে সবুজ ঘাসে
কুয়াশা যেভাবে মিলায় হিমালোকে
গোধূলি যেভাবে জড়ায় গমের ক্ষেতে
মুক্তাদানার মতো অপরূপ মন নিয়ে
মেঘমল্লার শরতের দিনে কী-বা
শাওন পূর্ণিমা চাঁদের রাতে; আহা!

আমারও যে মৌমাছির মতো প্রান হয়!
আমারও যে পিপীলিকার মতো শূঁড় হয়!

এলভিস

হাওয়াই মিঠার মতো
চুপসে গ্যাছে অধিকারের সীমা;
নিরাপত্তাহীন জিম্মি জীবনে আমাদের
আশঙ্কার খেপলাজাল ঘিরে রাখে প্রতিদিন।
গন্ধরাজের সৌরভ কোথাও নেইÑ
তবু প্রস্তুত হই
তবু স্বপ্ন দেখি
কোনো এক নাবিকের হাত ধরে
বির্নিমাণের তরঙ্গ
ফিরিয়ে আনবে হারানো সালতামামি!

ভোরের মুয়াজ্জিন আজান হাঁকবে
সালাতের রোশনাই ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকÑ
ভাটির পলিমাটিতে ফের
কৃষকের লাঙ্গলে চাষ হবে
পেঁয়াজ রশুন আদা…
কারখানার কলে সুতা ঘুরবে
পাটের গন্ধে ম ম করবে রাস্তার ধার।
মক্তব মাদ্রাসা স্কুলে
কলকাকলির মিছিল হবে;
একুনে অপেক্ষায় ক্লান্ত প্রেমিকা
হাতে বোনা উলের সোয়েটারে
আকাশের রং ছড়িয়ে দেবে স্বাধীনতার আনন্দে…

আর মৌ-মাছির মতো কর্মময় মেজাজ
নেমে আসবে উম্মাহ জীবনে। যে জীবন
এলভিস (মধু) আহরণ করেÑ যার ব্যবহার
প্রজাপতির ডানার মতো অপরূপ; যার মস্তক
ঐতিহ্য খুঁজে ফেরে সেজদার জায়নামাজে।

 

হিন্দের যুদ্ধ এবং আমাদের প্রায়শ্চিত্ত

আমরা কাঁদছি-
কেননা একটা পাখিকে ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে।
আমরা উষ্মা প্রকাশ করছি-
কেননা ক্রিকেটে ছেলেরা ভালো খেলেনি।
আমাদের অভিমান-
কনসার্টের রাতটা দীর্ঘ হলো না!
আমাদের অভিযোগ-
ছোট লোকের দল রিক্সার ভাড়া কেবল বাড়িয়েই চলেছে!
আমাদের ভাব-
ডালহৌসি শহরের শৈলশিখরের মতো গাম্ভীর্যপূর্ণ!

সাইবেরিয়ার শীত আমাদের ছুঁতে পারে না
যেভাবে পারেনি সাদত হাসান মান্টোর কাশ্মীর।
মধ্যপ্রাচ্যের গরম আমাদের ছুঁতে পারে না
যেভাবে পারেনি মাহমুদ দারবীশের ফিলিস্তিন।

চায়ের আড্ডায়; রাজনীতির আলাপে-
জাস্টিন ট্রুডোর মতো আমরা হাসতে জানি।
অংকে তেত্রিশ না পেয়েও অর্থনীতির ছক্কায়
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো জোকস করতে জানি।

আমরা এমন এক বীর জাতি; স্বাধীনতার আলাপে-
আঙুল তুলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো হুংকার;
তুড়িতেই ধরে রাখতে জানি আর বন্ধুত্বের ঋত পরিশোধে
মীরাবাঈ হতে পারি।

আমাদের জিভ-
তোষামোদ পেলে; হয়ে ওঠে লালাময় দীর্ঘ…

আমাদের স্বপ্ন-
দ্রব্যমূল্য প্রথম আকাশ ফুঁড়ে সপ্ত আকাশে পৌঁছাবে আর
ফেরেশতার রিফিউজ ক্যাম্পে থালা পেতে আমরা মান্না ও সালওয়া খাবো।
আমাদের স্বপ্ন-
পদ্মার মতো সমস্ত নদী শুকিয়ে মরুভূমি হবে আর
বুর্জখলিফা’র মতো আমরা বুর্জবাংলার অধিকারী হবো।

আমাদের শিউলী বেলী গন্ধরাজ-
সুরভী ছেড়ে ইউরোপ আমেরিকা থেকে আমদানি করবে
বারুদ তামাক কর্পূর আর বিলিয়ন টন গন্ধ বিলাবে
আমজুম আঁশ গোলাপ জামের বিস্তীর্ণ বাগানে।

আমাদের উড়োজাহাজ ট্রেন স্টিমার বাস
নীল গেরুয়া সাদা সবুজ রঙের ক্যানভাসে মনোরম হয়ে উঠবে-
যেমন গোধূলির বিকেলটা হয় রমণীয়!

আমাদের রাস্তায় হুইসেল বাজিয়ে দাপিয়ে বেড়াবে
খাকি ইউনিফর্ম পরিহিত দণ্ড-পাণ্ডব! তারপর-
পোঁদের চামড়া তুলে নেবার গর্বে; আমাদের সিনা
হাওয়াই মিঠার মতো ফুলে উঠবে আর আমরা ভেবে নেবো
আমাদের পিতা বোকা ছিলো!
আমাদের পিতামহ বলদ ছিলো!
আমাদের পরদাদা আবাল ছিলো!
কেননা এমন সব লোভনীয় স্বপ্ন ছেড়ে তারা
পলাশী শ্রীরঙ্গপত্তম নারকেলবাড়িয়া বালাকোটে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় রক্ত ঝরিয়েছে…!

সিনাই উপত্যকার মরুঝড় ফের আকাশে বাতাসে স্ফুলিঙ্গ ঝরাবে-
মিছে স্বপ্নের মিথ; দুমড়েমুচড়ে আমাদের টেনে নেবে হিন্দের যুদ্ধে আর আমরা
পিতা পিতামহ পরদাদা’র ঋত পরিশোধে যুদ্ধের রক্তসমুদ্রে নিমজ্জিত হবো আগাগোড়া।

কামনার ফুল

একটি শিউলি
একটি গন্ধরাজ
একটি বকুলের বাগান
কামনা করেছি আজন্ম-
যেভাবে আমাদের বিবাহ ছিলো
বেলী, ছাতিমের সুবাসের মতো স্নিগ্ধ।
গভীর কুয়াশায় শ্বাস টেনে বুঝে নিয়েছি
কাঠগোলাপ, মধু-মালতীর ঘ্রাণ বৈচিত্র!

কাঁঠালচাঁপার মৌসুমে দোলন আর কনকচাঁপা
বিমোহিত করেছে; যেভাবে আমাদের সন্তানের জন্ম
হাসনাহেনার সুরভির মতো মৌ মৌ গুঞ্জন এনেছে
গুলমোহর, পলাশ, শিমুলের আঙিনা ছাড়িয়ে জোছনামাখা শাপলায়।

কামনার রং
সারি সারি ডালিয়া, সূর্যমুখী
রক্তকরবীর ক্যানভাস মাড়িয়ে
কামিনীরাঙা রাতকে করে প্রার্থনা-
যেভাবে আমাদের সংসার হয়ে ওঠে
পরিপাটি সুনসান বাগানবিলাসী মনোরম!
প্রখর রোদ্রে; ঘাম মুছতে মুছতে বুঝে নিয়েছি
কালোগোলাপ, নীলপদ্ম’র সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা।

জুঁই, চামেলী, চন্দ্রমল্লিকা আর সুবাসিত
মহুয়ার প্রেম; যে আদিম মাদকতায় স্পর্শ করেছে
অপরাজিতার ঠোঁটÑ সেখানে চেরির নরম আগমন
আকাশস্নানে ধুয়েমুছে আমাকে করেছে বিমুগ্ধ নয়ন।

রজনীগন্ধার শীষ জানে-
কামনার বাসরে নাইটকুইন আরদ্ধ হলেও
হিজলের ডালে ডালে; লেগে থাকে আদিম মায়া।

 

রক্তাক্ত পাখি

একটা শাদা পাখি, উড়ে যাচ্ছে- পালক রক্তাক্ত…
সেই কবে; রাশান বিপ্লবের যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছে!
গন্তব্যের পথে, একটা পাহাড়ী অরণ্য অপেক্ষায়-
জন্ম অবধি কুচো শামুক, পোকামাকড় যার খাদ্য
যে ছিনিয়ে নেয়নি মানুষের ব্রেকফাস্ট কিংবা লাঞ্চ।

একটা শাদা পাখি, যার পালক বেয়ে রক্ত ঝরছে-
যার ওমে ঘুমিয়ে পড়ে নতুন দম্পতি, আলুথালু
পৃথিবীর ডিনার- যার সুরের শত্রু আব্রাহার হস্তী;
তাঁর জন্যে; ভোরের আলোড়নে মিছিলের ঠোঁট
গেয়ে উঠবে কী সমন্বিত দাউদের (আ.) যবুর…!

আহা মানুষ- স্রষ্টার মানুষ! কেন রাঙাও হাত
ক্ষমতার খঞ্জরে? আস্তিন গুটায়ে চেয়ে দেখো
বিপ্লব ছিঁড়ে টুকরো টুকরো… মতবাদের ফাঙ্গাস
পাহাড়, অরণ্য, জলাশয়, লোকালয়Ñ কোথাও নেই
অথচ নিশঙ্ক উড়ে যাচ্ছে; পালক রক্তাক্ত একটা শাদা পাখি।

 

হাঁস পাখির ধূসর ডিম

কত অসংখ্য বিকেল ফুরিয়ে গেলো
হলুদ সময়ের মুখোমুখি-
ছলনার বাহুডোরে খসে পড়া বন্ধুত্বের মুখোশ
গন্দম ফলের মতো পায়চারি করে চারপাশ…

কি এমন তুমুল প্রয়োজন ছিলো সুর তোলার?

যে তার ছিঁড়ে যায়; যে বারুদ বের হয়ে যায়
তাকে বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় ওজন করা যায় কী!

খোলা হয়নি জীবন সিন্দুক- কেননা
যদি জেনে যাও সেই সব বিকেলের সবিস্তারকথা;
তবে পাখির পালকের বিচিত্র রঙে গুলিয়ে যাবে
আমাদের গাঢ়-ঘন নিশ্বাস…

মাংসের স্বাদ যেভাবে লেগে থাকে জিহ্বায়
চোখের নেশা যেভাবে জেগে থাকে হৃদয়ে
ঠিক সেভাবে; ঠিক সেই ভাবে সমর্পিত হয়
সে সব বিকেলের জলছবি ঘর- যা কিছু
অপেক্ষমান সবুজ সিগনালে সমীরণ…

এক দমকা হাওয়া ছিনিয়ে নেবে
তোমার-আমার চৈত্রের আলাপন-
বরফাচ্ছাদিত বহু পুরাতন শহরের মতন
আড়ষ্টতায় থমকে যাবে ঠোঁট-জিহ্বা আর
স্থির চোখ চেয়ে থাকবে কেবল হাঁস পাখির
ধূসর ডিমে জন্ম নেয়া নতুন পৃথিবীর দিকে।

দোয়াতকলমের ডগায় জেগে ওঠা
রেনেসাঁর সুগন্ধ পাবে না আমাদের নাসারন্ধ্র
শুনবে না সেই সব সুখের মধুগুঞ্জরন…

 

১৭৫৭ এবং আমি

আমি বাংলাদেশ থেকে বলছি:
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আমার সীমানা
আমি বাংলায় কথা বলি…

আউশ আমন বোরো ইরি’র ভাটি অঞ্চলে
মাছ-ভাত আমার জাতীয় খাবার।

পাঞ্জাবি পায়জামা লুঙ্গি ধূতি টুপি আর পৈতা
আমার সাধারণ পোশাক।

আমার মা বোন স্ত্রী সালোয়ার-কামিজ
হিজাব বোরকা আর শাখা সিঁদুর শাড়ি পরেন।

আমি আর আমার বাবা-ভাই দাঁড়ি-গোফ রাখি; শ্মশ্রু মুণ্ডন করি…

আমাদের ঘরগুলোর বেশিরভাগ
ছন খড় গোলপাতা টিন টালীর ছাউনি মাটির দেয়াল…

ডাক্তার কবিরাজ ফকির বৈদ্য ওঝা’র এই দেশ
জারি সারি ভাটিয়ালি মুর্শীদি বাউল পল্লীগীতির
শাপলা শালুকে মিলেমিশে জোছনাচন্দনে একাকার…

মক্তব মাদ্রাসা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়
কোথাও নেই জ্ঞানহীন চর্চার পাঠদান…

এখানে মুয়াজ্জিন পাঁচবার আজান দেয়;
পুরোহিত-ঠাকুর দেয় উলুধ্বনি।

এখানে মসজিদ মন্দির গীর্জা আর পীর-বুজুর্গ
সন্ন্যাসীর মাজার মঠ আশ্রম সম্প্রীতির প্রতিষ্ঠান…

এখানে ঈদ অগ্রহায়ণ পূজা’র উৎসবে
ঘরে ঘরে আমোদ পড়ে আর আকাশে ওড়ে
লাল নীল হলুদ সাদায় হরেক রকমের ঘুড়ি…

আমি বাংলাদেশি-
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আমার সীমানা।
কেন আমি এ কথা লিখতে গেলাম? কারণ-
ভাটি বিধৌত তিলোত্তমা এ দেশটিকে কেউ কেউ
কেবল মাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে
অস্থিতিশীল করে তুলতে চায় আর
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবে বাঙালি বাঙালি বলে
আমাদেরকে করে তুলতে চায় বনজ গিরগিটি…

সবিনয় জেনে রাখুন, হে আমার বিশ্ববাসী-
এভূখণ্ডে বাসরত আমার পরিচয়:
“আমি বাংলাদেশি; আমার ভাষা বাংলা”…

আমি বাংলাদেশি যুবক!
কবিদের ঘরে ছুঁড়ে দিয়েছি এজলাস
এবার বিচার করুন ১৭৫৭ এবং আমার…