শ্রেণিতে বিভক্ত সমাজ প্রতিনিয়ত পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাতে লিপ্ত। এই দ্বন্দ্বটা আপতদৃষ্টে গোচর না হলেও পরিবর্তনগুলোর দিকে তাকালে তার উপস্থিতি সচেতন উপলব্ধি করতে পারেন। সংঘাতগুলো দৃশ্যময় নয়; তার কারণ অভাবটা ভাষার। ক্ষমতাবান শ্রেণি আর তো কিছু দমন করে না যা দমন করে তা ভাষার বাঙময়তা। তাই দমিত শব্দ বাক্য বাক্যাংশ অন্য শব্দ, অন্য ভাষা বা রূপক আকারে প্রকাশ পায়, যা ফিরে আসে নতুন আকারে অধীনতামূলক ভক্তিরস।
আসলে যা দমন করা হয়েছে তা ভাষা। নিপীড়িত শ্রেণি নানা অবদমনে ভাষার উচ্চাঙ্গতা থেকে নিশ্চুপতার প্রহরে এলায়িত হয়।ফ্রয়েড-এর মতে আবেগ বা আসল বস্তুর ধংস নেই, যা ঘটে তা কেবলরূপান্তর। শিল্পই পারে এই সব মূঢ়-মুক জনপদের অবদমিত ভাষা রূপকে চেনা প্রতীকে ছড়িয়ে দিয়ে ভাষার নীরবতাকে টুটে দমিত ভাষাকে ভাষ্যে ভাষ্যে ভাষাময় করে তুলতে।
শিল্পের মূল্য অনেক পরিমাণেই নৈতিক। শিল্পের উপর মরারিলিটির দাবি তখনও অস্বীকৃত হয়নি আজও না। এখনও তা ব্যক্তিক নয়, বরং সামাজিক। সুতরাং শিল্পীর ধ্যানের ভিত্তিটাই হবে অর্থনৈতিক আধ্যাত্মিক নয়। সামাজিক জীবন পরিশোধনের অনুপান। ভাল কবিতা/শিল্প কোনটা জানতে হলে জানা দরকার ভালো কবিতা/শিল্প কি? ভালো কবিতা/শিল্প কী তা না জেনও আমরা চিনে নিতে পারি কোনটি ভালো-আমাদের বোধি জ্ঞানের সাহায্যে।
বলতে গেলে কবিতা/শিল্প কী, এ সমস্যা প্লেটোর সময় থেকে বহু মতবাদ ও মতবিরোধের সৃষ্টি করেছে। কবিতা/শিল্প মর্মগত দিক থেকে নানা শ্রেণিতে সাজানো যেতে পারে। পারমার্থিক যা ভাববাদী, পরম্পরাগত যা অতীতের রীতিনীতি বোধ থেকে উৎসারিত এবং সামাজিক যার মধ্যে বোধের সরল উপলব্ধি প্রেম যৌনতা আবার দ্রোহের আগুনসম ভাষা রয়েছে। এরপরও আছে আখের গোছানোর প্রস্তুতি।
যদিও বিভক্তির কারণে শ্রেণিগুলো সমাজ সংগঠনে আবদ্ধ থেকে স্ব স্ব শ্রেণির চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করছে এবং আরো গণ্ডিবদ্ধ হয়ে ক্ষমতাবান শ্রেণির সন্তুষ্টির জন্য অন্দরমহল খুলে দিচ্ছে। তারা তাদের শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসা সুযোগ হারিয়ে খয়রাতি প্রাপ্তির জন্য মারমুখী ভালুকদৌড় দৌড়াচ্ছে আর ক্ষমতাবান শ্রেণি কুমিরকান্নার অশ্রু ঝরিয়ে জনগণের ম্রিমানতার সুযোগে তাদেরকে নানাভাবে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরে ঐক্যবদ্ধ চিন্তার অভিধান থেকে সরিয়ে ভাষাহীন করছে। দরিদ্র আরও দরিদ্র, আর অন্যন্যরা ধীরে ধীরে হতদরিদ্রের স্তরে যুক্ত হচ্ছে।
সমাজের লেখক কবি সাহিত্যিক শিল্পী সকলেই কোনো না কোনো বিভক্ত শ্রেণির মানুষ। তার সকল অনুভব তার শ্রেণির রুচি অভ্যেসের সাথে পরম্পরাগতভাবে যুক্ত। স্ব-চিন্তা, স্ব-কার্য, স্ব-ভাবনা থেকে বিচ্যুত এই মানুষগুলো ভাবতেই পারে না কী তাদের হারিয়ে গেছে। তাদের চিন্তা চেতনায় তাই সামগ্রিকতার প্রকটতা প্রশ্নাকারে হা হয়ে উঠছে। বরং বলা যায় তারা যা ভাবেন লেখেন আঁকেন সুর দেন তা সবই মাস্তান শ্রেণির মানুষের পরিতোষণের উপায় হিসেবে খাড়া হয়ে থাকে। এবং স্ব-শ্রেণির শৃংখল মুক্তির প্রকৃত দিশা না হয়ে বাস্তবে ধনিক শ্রেণির পদলেহন প্রিয়তার মধ্য দিয়ে নিজের নাম-কাম দুটো পয়সা, তৃতীয় শ্রেণির পুরস্কার উদ্ধারে গলদঘর্ম হয়।
আসলে এরা কেউ চারিদিকের পরিবর্তনের গতিকে অনুধাবন করতে পারে না। বিভক্ত শ্রেণির স্তরভেদের চিন্তা এতোটাই অতীতগামী যে তারা ইতোমধ্যে যেসব পরিবর্তন ঘটে গেছে অর্থনীতিতে, সামাজিক রীতিতে, রাজনীতিতে, দর্শন চিন্তায়, বিজ্ঞানে এবং বিশ্বব্যবস্থায় তার খোঁজ না রেখে মানসিকতার দিক দিয়ে অতীত ব্যবস্থার প্রিয়তায় বকের ঠোকরের মতো ঠোকর দিয়ে কিছু উপাদেয়তা অন্বেষণ করছে। ফলে যে সামন্তীয় সমাজ বহু আগে ভেঙে গেছে, জন্ম নিয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, পুষ্ট হচ্ছে আধুনিকতা যার মধ্যে সেও বসবাস করছে, তার প্রযুক্তি ব্যবহার করছে তার আহার বিলাসের মধ্যে কালাতিপাত; সেসবে তার খেয়ালে নেই, রয়েছে মধ্যযুগীয় চিন্তার ভরা ধামা, তার রীতিনীতি এবং নানা উপাচার।
এ জন্যই একজন শিল্পীকে/কবিকে পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করে বিষয় নির্ণয় করতে হয় প্রথম; এবং তারপর তার রূপটি কেমন হবে, কতটুকু প্রসারিত বা সংকুচিত করলে আবেগমাত্রায় চারপাশের কাঠামোর সংগে সাযুজ্যপূর্ণ হয়ে সামনে এগুবে কবি/শিল্পীকে সে ভাবনাই সক্রিয় রাখতে হবে।
শিল্প আজকের নয়, কালকের নয়, বহুকালের চিরায়াত এ সব আপ্তবাক্য এ কারণে যে বস্তুর ধ্বংস নেই আছে রূপান্তর। মানুষের পৃথিবী বস্তুময়। মানুষই বস্তুর রূপান্তর ঘটিয়ে কল্যাণের প্রকৃতি তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য আজকের প্রকৃতিকে হিউম্যানাইজড ন্যাচার বলা হয়। অতীত অবশ্যই ইতিহাসের অংশ। অতীত থেকেও শিখবার জানবার বিষয়াদি আছে আর তার ভুল ও গৌরবকে সংগে করে মানুষের এই অগ্রযাত্রা। কিন্তু ভাবনায় রূপের পরিবর্তন ঘটে সমাজ পরিবর্তনের মূলধারার সংগে সম্পৃক্ত হয়ে। কবি শিল্পীকে তা অনুভব করতে হলে ক্ষুদ্রের নয় বৃহতের দিকেই চোখ ফিরাতে হয়। তা হলেই তার সৃষ্টি বেশির কাজে লাগে। বাস্তবে প্রত্যেক শিল্পীই তার কালের। কাল বদলালেও অভ্যেস রুটি, সংস্কৃতি বদলে আসতে সামাজিক উত্তরণের দরকার।
যদিও চেতনা হারানো এবং বর্তমানের লক্ষণগুলো জানতে বুঝতে যে পরিমাণ আগুনবুক আমাদের সৃজনশীল মানুষদের থাকার কথা তার ‘উন্মেষ’ এখনও দীপ্তমান হয়নি চেতনা জগতে। ফলে কিছু পেতে চাই, কিছু পাওয়া গেল, কিংবা পেলাম না, যদি মেলে… তখন তারা স্তবস্তুতির ঝাঁপি নিয়ে সাঁপুড়ের মতো বসে পড়ে এবং জনগণকে সেই সামন্তীয় যুগের শিল্প কচালানি নানা উপাদেয়তায় পরিবেশন করে। ফলে কোনো সৃজনশীলতা পড়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর হৃদয়কে উদ্বেলিত করে না। কারণ একদিকে রুচির বদল, অন্যদিকে সামাজিক অস্থিরতা সামগ্রিকভাবে সমাজে দেহে চামউকুনের মতো পরজীবীর উপস্থিতি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়া বোধগুলোয় নদীর চরের মতো বালিয়াড়িতে উঁচু করে তোলে। সামাজিক জীবনে উপেক্ষিত এই সব শিল্পবোধ জনগণ-মন থেকে বিস্মৃত হয়ে একটা অকাজের কাজে পরিণত হয়।
কু’সংস্কৃতির প্রভাব সমাজের নিচুতলা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কাকা, চাচা হয়েছে আঙ্কল, কাকি, চাচি বা খালা মাশি পিশি হয়ে গেছে আন্টি, দাদি নানী হয়ে গেছে গ্রানি, বেহেস্ত দোজখের ইজারাদারদের লাইন হচ্ছে দীর্ঘতর, কর্ম-হুশের বিপরীতে জমেছে স্বর্গীয় রতিক্রিয়ার বিচিত্র মেঘা ন্যারেটিভ, নারীকে অন্দর মহলে ঢুকিয়ে ফায়দা হাসিলের ফর্মূলার নবতর সংযোগ বিশ্বব্যবস্থাধারীদেরকে তাদের কুকর্ম থেকে আড়ালে করছে। এখন পড়ে যাওয়া শ্রেণিগুলোর হাতেও ‘স্টার জলসার’ নায়িকাদের মতো সেল ফোন। অর্থাৎ প্রয়োজনে প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, রঙ্গ তামাশায় গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টিও মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সংক্রমিত হয়ে পুঁজি তুলে দিচ্ছে বহুজাতিকের ঘরে। কর্মবিশ্বাস টলে গিয়ে কতকটা ফরমায়েশী কর্মসম্পাদন স্তরগুলোতে নিত্যের রুটিন হয়ে উদ্ভাবনী বিলুপ্ত করছে। শুরু হয়ে গেছে নব্য দাসযুগ যা ফিরে আসছে অতীত থেকে নতুন রূপে নতুন পোশাকে।
সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার ছকে আবদ্ধ পছন্দের বাধ্যবাধকতা তাকেই আজ উত্তরাধুনিকতা বলে খাড়া করিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা। ‘আধুনিকতা শেষ হয়েছে বলেও গবেষণা শেষ করেছে তারা। এখন আর স্বাধীন পছন্দের কোনো সুযোগ নেই, বিজ্ঞাপন আটকে দিয়েছে মানুষের বিবেচনা। পছন্দের স্বাধীনতা যেই দিন মানুষ লাভ করবে সেই দিন ‘আধুনিকতার ছদ্মবেশ’ উত্তরাধুনিক তামাশার অন্তষ্টিক্রিয়া। কারণ আধুনিকতা স্থবির নয়, গতিশীল, উত্তোরোত্তর অগ্রসরমান।
প্রতিটি বাঁকে তার পরিবর্তন নানা সংস্কার নিয়ে মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সমাজ মানুষ তাকে সেই গতির সাথে যুক্ত হয়ে পুরানো চিন্তা, পুরানো নির্মাণ, পুরানো ভাষার গতিহীনতাকে নতুন মাত্রদিয়ে নতুন করে বিনির্মাণ করে নতুন সংস্কৃতি। আধুনিকতা শেষ হয়ে গেছে, শুরু হয়েছিল উত্তরাধুনিক আবার উত্তরাধুনিকও শেষ গোধূলি আভা ছড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে, হয়তো আসছে অন্যকিছু; এ হলো পুঁজিবাদের বিকৃতি, খ্যামা দেয় না। না পুষলে যুদ্ধ লাগাও, খতম করো লাখ লাখ মানুষ, ধ্বংস করো স্থাপনা, কারণ লড়াইটার স্বার্থ ক্ষমতার বাহাদুরি পুঁজির অমোঘ, পুঁজির সংকট প্রশমন এবং তার পর যা নির্মাণ হবে হ্যাঁ অনেক কিছু বদলাবে, বদলাবে যুদ্ধ কৌশল, বদলাবে সমর বিদ্যা, বদলাবে নতুন আক্রমণের বিষয়াবলী এবং এভাবে তা ছাপ ফেলবে জনজীবনে, কিন্তু জনগণ ভাষার অভাবে ভাষাহীন, সে দমিত। সে হবে আধুনিকত্তমের নতুন শিকার। কিংবা অন্য কিছু। আসলে সমাজ সভ্যতা সামনের দিকেই এগোয়।
কিন্তু এসব তো এমনি এমনি শেষ হবে না, তার জন্য জাগরণ চাই, শ্রেণির দ্বন্দ্বটার একটা মিমাংসা চাই, আর তার ক্ষেত্রটার জন্য চাই চেতনার স্তরে নতুন হ্যামারের পিটান। যাতে মিথ্যেটাকে উল্টেদিয়ে নতুন সত্যের স্ব-রূপটা অনুসন্ধান করা যায়। কবি/শিল্পীরা কেবলমাত্র মানুষকে তার বন্দীত্বের মোহাক্রান্তির ঘুম থেকে জাগরণের আবেগটুকু উসকে দিতে পারে। তার আঁকায়, তার সুরে, তার নির্মাণে -আর তার জন্য তারই প্রথম নির্মোহ হওয়া জরুরী। নইলে সৃষ্টি কেবলি, এমন কী একজন দক্ষ শিল্পীও কেবলই শিল্পী থাকবেন, তিনি বিত্তবান শ্রেণির তোষক হবেন এবং শ্রমের অপচয় করবেন আর তারা তা কিনবে এবং অশ্রদ্ধায়ই তাদের ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে নিজেদের গৌরবের কলেবর বৃদ্ধির জন্যে।