গুচ্ছ কবিতা : সাহেদ মন্তাজ


বুকের বোতাম খুঁজি

তোমার বুকের বোতাম খুঁজে ফিরি
কতদিন হলো
ও-ভাঁজে মুখ গুজে পড়ে থাকবো-
বেহুলা বাংলা
ও-আঙিনায় পেয়ে যাই বিশ্বপুকুর
ডানকানারা খেলা করে
শৈবালের ফাঁকে ফাঁকে
চ্যাঙ-শোলের আড্ডা তার নীচে;
ধারে গাবগাছের শীতল ঘন ছায়ায়
মেতে উঠবো মার্বেলে
খোলায় ধানের চারায় হাঁস-মুরগির সাথে
কাঠবিড়ালির লুকোচুরি থামাতে ভুলে যাবো;
ওয়ারেশের বাগে তপ্ত দুপুরে
দিঘির চিকচিকে বালুতে
ঝিনুক খোঁজার আনন্দ
ওই ভাঁজেই ভুক্ষুর আধার
আইলভরা ফড়িংয়ের সবুজ উদ্যান
ভুলুকে নিয়ে কেটে যাবে
সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত,
ফাগুন হাওয়ার অপেক্ষা আর উদ্বেগে কাটে নিশি
ও-আকাশে ডাঙঘুড়ি উড়াবো বলে,
ওই আঙিনায় বায়োস্কোপে চোখ রাখি
হাওড়া ব্রিজ ভুট্টোর উঠোনে রেল লাইন…
ওখানেই বসে স্বাধীনতা আর বিজয়ের উৎসব
নবীর শিক্ষা, বীরপুরুষ, কবর, মায়াবন বিহারীনি আর

ওয়াগান ব্রেকার, আয়নায় বন্ধুর মুখ কিংবা
ফায়েগের ব্রেকড্যাঞ্চের জন্য প্রতীক্ষা;
ওই ভাঁজে নতুন গরুর হাট
প্রতি রোববার নতুন সূর্য ওঠার আনন্দ,
সন্ন্যাসখোলার পুজোয় খাবার
মাটি আর কাঠের খেলনা নয়তো
ঘড়ি, চশমা, পিস্তল আর ইঞ্জিননৌকা কিনে
খুশিতে বাড়ি ফেরা,
তাই তো তোমার বুকের বোতাম খুঁজি
স্নিগ্ধভাঁজে মুখ গুজে শুয়ে থাকবো বলে
ক্লান্তিহীন অনন্তকাল।

 

অসমাপ্ত আলাপন

প্রিয়
আমাদের সব আলাপন কি শেষ হয়েছে?
নাকি অব্যক্ত থেকে যাবে হৃদয়ের
আরো কিছু কথা
সঙ্গোপনে কিছু দুঃখ যদি থাকে থাক
বৃষ্টি নামলে নিঃসঙ্গতায় ডুবে
উদাস মনে রাত জাগতে ক্ষতি নেই,
বন্ধু
চেয়ে দেখো-
সময় কত দ্রুত গত হচ্ছে
পুষ্পাচ্ছাদিত বৃক্ষ বয়সের ভারে
শ্রীহীন হয়ে পড়ছে
দেখো আমাদের প্রাণপ্রিয় ভূমিতে
শত সহস্র মৃতদেহ সমাহিত হয়ে আছে
সময় কেবলই বয়ে চলে
শেষ সীমানার পানে
তার আর ফিরে আসা হবে না
কোনো ক্রন্দন কোনো মাতম
তাকে কখনো স্পর্শ করবে না,
প্রিয়
তবে এসো-
আমরা শেষ করি সব আলাপন
আমাদের অপূর্ণ থেকে যাওয়া
পাওয়া না-পাওয়ার গল্পগুলো
যদিও কখনো শেষ হবার নয়!

মানবতার পরাজয়

সভ্যতার দাবিদার পশ্চিমারা
ফিলিস্তিনে হাজার হাজার নারী শিশু বৃদ্ধ যুবক-যুবতীকে
নির্বিচারে হত্যায় জায়নবাদী ইসরাইলকে সমর্থন দিচ্ছে
অবিচল চিত্তে
মনুষ্যত্বের এই পরাজয় দেখতে হলো বিশ্বকে
বিবেকহীন পররাষ্ট্রনীতির শিকার অসহায় বনি আদম
কিন্তু ওরা ক’জন মাত্র ক্ষমতাধর
ওরা শান্তিরক্ষার প্রতীজ্ঞাকে কেবল জলাঞ্জলি দেয়নি
বিসর্জন দিয়েছে মানব সভ্যতাকে
নির্মম নিষ্ঠুর বীভৎস পাপাচার ক্ষমতাচর্চা
কেবল প্রকৃতির বিধানের জন্যই কি অপেক্ষা করতে হবে
সংখ্যাগরিষ্ঠ সত্য মানুষকে?
জায়নবাদী বর্বরতায় নিশ্চিহ্ন প্রতিটি গৃহ আঙিনা সভ্যতা
বর্বর আক্রমণ থেকে বাদ নেই
হাসপাতাল কিংবা মসজিদ মন্দির গির্জা
এ কেমন নিষ্ঠুরতা!
জীবন বাঁচাতে মানুষ ছুটছে ক্রমাগত
এক শহর থেকে আরেক শহরে
তবুও কোনো রক্ষা নেই
খাদ্য নেই পানি নেই ওষুধ নেই বিদ্যুৎ নেই
নিরন্ন বুভুক্ষু মানুষের জন্য
কোনো সাহায্যও পৌঁছতে দিচ্ছে না সন্ত্রাসী ইসরাইল
একী মনুষ্যত্ব বিবর্জিত ভয়াবহ ধ্বংস তাণ্ডবনৃত্য
সভ্যতার নামে সন্ত্রাসদমনের নামে আত্মরক্ষার নামে
প্রতিরোধের নামে এই অগণন প্রাণবধ নীতি,
কি দোষ অবুঝ দুধের শিশুদের?
গুলি বোমা গ্রেনেড ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে
রক্তাক্ত জর্জরিত হতে হবে
বিঘোরে মরতে হবে
আধিপত্যবাদ জাতিবিদ্বেষ জাতিগত নিধনের
এমন জঘন্য প্রকাশ্য আক্রমণে

পশ্চিমাবিশ্ব নির্লজ্জের মতো সমর্থন দিচ্ছে কোন দায় থেকে?
মানুষ কেন ভুলে যায়-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই’
তবে কি মানবতার কোনো দায় নেই?
যদি হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধ বনিতা হত্যার
বিচার না হয়
যদি প্রতিবাদ না হয়
অবশ্যই প্রকৃতি প্রতিশোধ তুলবে নিজের হিসেবে
নিজের মতো করে
সেদিন হয়তো আমরা নিরুপায় থাকবো
নিতান্ত অসহায় হয়ে পড়বো প্রকৃতির কাছে।

আকাশ ছোঁয়ার আনন্দ

আমার গ্রামের ঠিক পরেই ছিল
গড়ের মাঠ
গড়ের মাঠের কথা মন উঠতেই
নিঃসঙ্গ কুলগাছ, পাশের খেজুর গাছ ও
একটু দূরের প্রাচীন বটগাছটার কথা মনে আসে-
যাকে নিয়ে অনেক রূপকথা।

গড়ের মাঠে বড়দের সাথে
নানান খেলার আনন্দে মেতে উঠতাম-
হাডুডু, গাদন, ফুটবল, ঘুড়ি উড়ানো
আরো কত কি ?

তখন মনে হতো-
আকাশ বুঝি মাঠের পরে
ঐ দূরের গাঁয়ে গিয়ে
নেমে গেছে মাটিতে
দূর থেকে শুধু কালো গাছের সারি দেখতাম
মনে প্রশ্ন জাগতো-
ওখানে বুঝি কোনো লোক থাকে না ?
কিন্তু ও দিক থেকেই তো
মাঠ পেরিয়ে লোককে
নতুন গরুহাটে আসতে দেখি
অতএব লোক থাকে, এবং
ওদেরই কতো আনন্দ
সুন্দর নীল আকাশটা
ওদের গাঁয়ে গিয়ে মিশেছে
সেই আকাশের গা বেয়ে
গাছ-গাছালির মধ্যে

ওদের ছেলে-মেয়েরা খেলা করে ;
একদিন যদি যেতে পারি
কতো আনন্দই না হবে।

কাউকে কোনো দিন জিজ্ঞেস করি নি-
মনে মনে ভেবেছি-
ঐ গাঁয়ের নাম কি?
কিভাবে জানতে পারি যে
ঐ গাঁয়ের নাম ছোটঘের
কোনো একদিন ছোটঘেরে
পৌঁছানোর বাসনা পূর্ণ হলো
কিন্তু সুনীল আকাশকে পরের
এক গাঁয়ে নামতে দেখি;
জানতে পারলাম- ওটা বড়ঘের
বড় ঘেরে যাবার বাসনা
মনে পুষে রাখলাম।

একদিন বড়ঘেরেও পৌঁছে গেলাম
কিন্তু আকাশ পাই নি
সারিবদ্ধ নানান গাছ-গাছালি
ফাঁকা ফাঁকা কিছু ঘর-বাড়ি পেয়েছি ;
মেনে নিয়েছি-
মাঠ পেরিয়ে
দূরে দেখতে পাওয়া কালো গ্রামই
সেই ঠিকানা
যেখানে যাওয়ার আগেই
কখন মন থেকে
আকাশ দেখার ইচ্ছে পালিয়ে গেছে
জানি না।

তোমাকে একটা কথা বলার আছে

শোন সানা
তোমাকে একটা কথা বলার আছে
অনেক দিন হলো
বলি বলি করেও বলা হয় না
ঠিক কি বলব
কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না
তবে বলা দরকার
আজকাল কোনোকিছু
সহজে মনে থাকে না
কখনও মানিব্যাগ, কখনও মোবাইল
কখনও বা হাতঘড়ি, কখনও রুমাল
কখনও চাবি, কখনও বা কলম
একটা না একটা কিছু ফেলে রেখে
অফিসে আসি
এর মধ্যে একটা কিছু সব সময়
মনের মধ্যে ঘুর ঘুর করে
অজান্তেই একটা নাম
উচ্চারিত হতে থাকে অহর্নিশ।

সে যাই হোক
আজ কথাটা বলতে চাই
তোমাকে শুনতেই হবে
অবশ্য তুমি নাও শুনতে পার
তাতে তোমার কিছু আসে যায় না
আমারই বা কি আসবে যাবে!

সেদিন তোমার সাথে রিকশা চড়ে
বলদা গার্ডেনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম
বললাম চলো- ওখানে বসি
তুমি বললে- না ;
বললাম- চলো নৌকা চড়ে বুড়িগঙ্গা পার হবো
তুমি বললে- অন্য দিন ;
আমি অনেকবার বলতে চেয়েও
বলতে পারি নি
সানা তুমি শুনবে ?