আত্মকথন: শহীদুল্লাহ ফরায়জী


প্রথমে গান লেখা শুরু করেছিলাম, আত্ম পরিচয়ের সঙ্কটে। এত বড় পৃথিবীতে আমার আত্মপরিচয়ের কোন জায়গা থাকবেনা, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমার একটা চিহ্ন থাকুক, সংস্কৃতি ও সভ্যতার জগতে আমার একটা দাগ থাকুক, সমাজ রূপান্তরের বিপ্লবে আমার একটা কর্মকাণ্ড থাকুক এসব ভাবনা প্রতিনিয়তই আমার ভিতর আলোড়িত হত। মানুষের মুক্তির জন্য নিজের আত্ম বলিদান এর প্রশ্নে আমার স্বপ্নও দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। কিন্তু জীবনের সেসব স্বপ্ন ভেঙে গেছে অজান্তেই। সমাজ পরিবর্তনে লড়াই করতে গিয়ে সমাজ পরিবর্তন করতে পারিনি কিন্তু নিজেকেই পরিবর্তন করেছি। ফলে আত্মপ্রকাশের ব্যাকুলতা থেকেই লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।

গান লিখে সহজে জনপ্রিয় হবার প্রবণতা আমার অস্তিত্বে দীর্ঘদিন বিরাজ করছিল। তবে সঙ্গীতে অন্তরাত্মার কথা নিসংকোচে বলতে চেয়েছি। বিরান হৃদয়ে সংগদান করেছি। মানুষের হীনমন্যতার বাইরে শুচিস্নাত আনন্দ দিতে চেয়েছি। অনন্তের পথে গানের স্বপ্ন বপন করে গেছি। কোন কোন সংগীত দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভবিষ্যতে গৌরবোজ্জ্বলও হতে পারে।
কিন্তু যখন বুঝলাম জনপ্রিয়তা কোন জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না, তখন জনপ্রিয় হবার যে স্বপ্ন প্রতিমুহূর্তে লালন করতাম তা হঠাৎ করে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল।

লেখার প্রসঙ্গে আসি। কি লেখি কেন লেখি?
যেহেতু অন্য কিছু করার যোগ্যতা নেই আমার তাই নিরুপায় হয়ে আমি আমার জীবনকে নির্বিচারে সাহিত্যের হাতে তুলে দিয়েছি। উপার্জনের প্রয়োজনে নয়, আত্মিক চাহিদার প্রয়োজনেই লেখার আশ্রয় নিয়েছি। সাহিত্যের নেশায় আমি আমার ভিতরের অন্য সকল অহংকারকে পরিত্যাগ করে ফেলেছি, জীবনের অনেক চাওয়া পাওয়াকে স্বেচ্ছায় ছুঁড়ে ফেলেছি, চাওয়া-পাওয়ার হীনমন্যতার যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছি।

সাহিত্য আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। জীবনের সৌন্দর্য গভীরতা আর উচ্চতা পরখ করার কোনো সুযোগ হতোনা যদি সাহিত্যের বিস্ময়কর সমুদ্রের অতলান্ত উপকূলে নুড়ি কুঁড়াবার প্রচেষ্টা গ্রহণ না করতাম। যদি সাহিত্যের অচেনা অতল গহবর অনুসন্ধানে নিজেকে জড়িত না করতাম, স্বপ্নের অগণন বালুকণার মত জীবনের বালুচরে আমি হারিয়ে যেতাম।

কেনো লিখবো, কি লিখবো কার জন্য লিখবো? লেখার সার্থকতা কি?
প্রাচীনকালের সাহিত্য-সমালোচক, সাহিত্য নির্মাণ তও্বে যুগান্তকারী ধারার প্রবর্তক লঙ্গিনাস বলেছেন, ‘কাব্য, জীবনের অনুকরণ হলেও শুধু জীবন উপস্থাপনাই কাব্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কাব্যকে যথাযথ কাব্য হয়ে উঠতে প্রয়োজন গভীর ধ্যান এবং অলংকার সহযোগে ভাষাকে নবরূপ দেয়া।
এর মাধ্যমে কাব্য হয়ে উঠতে পারে মহিমান্বিত সুন্দরতর এক শিল্প বিশেষ। যার মাধ্যমে লেখকও গৌরবের সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারেন। উৎকর্ষময় রচনার একটা অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আছে যা আমাদের আত্মাকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করে, আমরা গর্বের মহিমায় এবং স্পর্ধিত আনন্দের অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হই।

আমার কবিতা নিঃসন্দেহে বিদ্যমান কবিতার সীমা অতিক্রম করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সামাজিক সংকটের সময় আমার কবিতা থেকে নৈতিক জ্বালানি সংগ্রহ করবে। কারণ কবিতার প্রতিটি অক্ষর অতল স্পর্শী জীবনের জয়গানে মুখরিত হয়েছে। কোন একদিন হয়তো আমারই কবিতা কবিতার অসীম আকাশে মেঘখন্ডের মতো ভেসে বেড়াবে, নক্ষত্রের মতো মধ্য গগনে জ্বলজ্বল করবে।

এই যে জীবন জিজ্ঞাসা, জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সাহিত্য কয়জন রচনা করতে পারেন। আত্ম আবিষ্কার বা আত্মপ্রকাশের সাহিত্য দেশ থেকে দেশান্তরে যুগ থেকে যুগান্তরের ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যের আলোর মত, ভেতরে বাইরে সমাজকে আলোকিত করতে চেয়েছে। বাইরের মানুষের জাতপাত আছে, ধর্ম বর্ণ আছে, ভাষা সীমান্ত আছে কিন্তু ভিতরের মানুষের তা নেই। ফলে যে ভাষাতেই মানুষের গভীর স্তরের বাণী বহন করে সাহিত্য রচিত হয়েছে তখনই তা সর্বজনীন হয়েছে। সাহিত্যের কাছে পৃথিবীর সকলেই আত্মার আত্মীয়। সৃষ্টি চক্র অহরহ আবর্তিত হচ্ছে মানুষের চেতনায়।

সাহিত্য হচ্ছে তাই যা, মানুষের মনে মহত্ত্ব ধারণা সৃষ্টির সামর্থ্য রাখে। যে সাহিত্য মানুষের মনে মহৎ মননের সৃষ্টি করতে পারে না, বা মহৎ মানুষ সৃষ্টির সামর্থ্য রাখে না সে সাহিত্য কালোত্তীর্ণ নয়। সাহিত্যে কেবল মহৎ হলেই হবে না তাকে সৌন্দর্যকেও লালন করতে হবে। এই যে কাব্যের সৌন্দর্য এটাই সাহিত্যকে পাঠকের কাছে চিত্তাকর্ষক করে তুলে। আর মহত্ব মানুষের ভিতরের ক্ষুদ্র জায়গা থেকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যায়, অদৃশ্য আনন্দলোকে নিয়ে যায়, মানুষকে উচ্চতর ভাবনায় উজ্জীবিত করে।

পাঠককে মহৎ নৈতিকতার সমকক্ষ করা, বারবার পাঠককে অনুপ্রাণিত করা, ব্যাপকতায় উজ্জীবিত করা, অনুভূতির মাহাত্ম্যকে গুরুত্বপূর্ণ করার দায় বহন করার সাহিত্য সৃষ্টি মুষ্টিমেয় কয়েকজনের পক্ষেই সম্ভব। এসব কীর্তি মানবজাতির কীর্তি। যাদের উচ্চতা মানবাত্মার উচ্চতা সমকক্ষ।

মানুষ অসীম অপার্থিব অবর্ণনীয়। নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে অজস্র রচনা প্রকাশ করছে। নাটক উপন্যাস গান এমনকি মহাকাব্য রচনা করছে কিন্তু তার রহস্য উম্মোচন কেবল বাকি থেকে যাচ্ছে। কত লেখা হারিয়ে গেছে, পুড়ে গেছে আর কত লেখা অমর হয়ে আছে।

আমার লেখার উৎস হচ্ছে নৈতিক উৎকর্ষ উত্তরণের প্রচেষ্টা, ইন্দ্রিয় দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের প্রচেষ্টা, নৈতিক পুনর্জন্মের প্রচেষ্টা এবং ঐশ্বরিক চুক্তি উম্মোচনের প্রচেষ্টা। আমার বিবেকের দংশন কোন ধরনের, আমার অন্তর্দৃষ্টি কতটুকু প্রখর, কতটুকু দিব্যজ্ঞান, অসাধারণ দুঃখবোধ, কতটুকু অনুভূতির সঞ্চার ঘটেছে আমার মনে তাই দিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছি। আমি হলাম পরম পথিক। জীবনের রাজপথে পরিভ্রমণ করছি, যা পেয়েছি তাই কুড়িয়ে নিয়েছি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমার পরিভ্রমণ যখন সমাপ্ত হবে সেদিন হয়তো আমার অভিসারিকা আত্মা পরম পরিতৃপ্তিবোধ করবে।

বিশ্বমানের সাহিত্য পেলেই আমার বুকের ভিতরে শিহরন জাগতো, ভিতরে কি একটা আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো, তাদের আশীর্বাদ লাভের জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে পড়তাম। আমি বিশ্বাস করি তারাই পুণ্যাত্মার অধিকারী, তারা আধ্যাত্মিক শক্তিতে ভরপুর। তাদের দেখার জন্য ভক্তমন্ডলী প্রাঙ্গণে ভিড় জমায়, কেউ সামনে লুটিয়ে পড়ে, কেউ অশ্রু বিসর্জন করে। আমাদের কালে এমন একজন ঋষি টলস্টয় নেই যার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মহৎ প্রতিভার আকর্ষণ থেকে নিজেকে কোনদিন মুক্ত করতে পারিনি। চিরজীবন যদি মহৎ ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে বাস করতে পারতাম-এ প্রত্যাশাও কোনদিন ত্যাগ করতে পারিনি।

লিও টলস্টয়, ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ভিক্টর হুগো, দান্তে, জোয়ান ভন গ্যোয়েটে, ইবসেন, হাফিজ, জালাল উদ্দিন রুমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কহলীল জিবরান, হাইনরিখ হাইনে, ওয়াল হুইটম্যান, ইভান তুর্গেনেভ, বালজাক, হাওয়ার্ড ফাস্ট, রাইনার মারিয়া রিলকে, বরিস পাস্তেরনাক এবং ফ্রা্নস কাফকা সহ বিশ্বসাহিত্যের ‘ক্লাসিক সাহিত্য’ পড়ার সুভাগ্য আমার হয়েছে। জীবনের হীরক সন্ধানে অনুসন্ধানী হওয়ার ব্রত সকল সময়েই আমার মাঝে বিরাজমান। মহাকাব্যিক বোধে জারিত দুর্লভ বইও পড়েছি এবং পড়ছি। অনুবাদ সাহিত্যই আমার মননের দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। অনুবাদ সাহিত্য ছাড়া আমার নৈতিক জগতের সৌন্দর্য অনাবিষ্কৃত থাকতো, আমার হৃদয় অনুর্বর থাকতো, অন্যায় প্রতিরোধে বিবেক আপসকামী হয়ে থাকতো।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিস্ফোরক হচ্ছে বই। বইএকমাত্র বিস্ফোরক যা বিশাল জগতকে তছনছ করে হাতের মুঠোয় তুলে দিতে পারে, যে ক্ষমতা পৃথিবীর অন্য কোন বিস্ফোরকের নেই। বইয়ের ভিতরের অন্তর্নিহিত শক্তি বিনষ্ট করতে পারে এমন কোন মারণাস্ত্র মানুষের নেই। বই মানুষকে আকাশ-পাতাল, স্বর্গ নরকে বিস্তার করে দেয়। বইয়ের কারণেই মানুষ জীবন সমুদ্রে মন্থন করতে পারে। জীবনের উচ্চতা এবং জীবনের গভীরতা যতটুকুই উপলব্ধির আওতায় আনতে পেরেছি সবটুকু কৃতিত্ব বইয়ের। আমিতো স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছি ‘স্বর্গ না দিয়ো গ্রন্থ দিয়ো’। বইয়ের কারণেই মূর্খ অহমিকা পরিত্যাগ করে বিনয়ের জায়গা দখল নিতে পেরেছি।

আমি সব সময় এমন লিখা লিখতে চেয়েছি যা মানুষকে মুক্তির আশ্বাস দিতে পারে। লেখার উদ্দেশ্য ছিল প্রলোভনের চৌহদ্দি অতিক্রম করে মহত্তম অভীষ্টের দিকে পাঠককে ধাবিত করা। মানুষের ভাবনার ভিতরে যে রহস্যের চাবিকাঠি আছে, অতলান্ত গুপ্তধন আছে তা উদ্ধার করে পাঠকের হাতে তুলে দিতে চেয়েছি। প্রচলিত সামাজিক ধ্যান ধারণার বাইরে, সংকীর্ণ নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে লিখতে চেয়েছি। মানুষ আত্মকলহে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে সেই বেদনাকে প্রকাশ করতে চেয়েছি। জীবনে যা কিছু সত্য, যা কিছু মহৎ তা প্রকাশ করতে চেয়েছি। চোখের জানালা আর হৃদয়ের দরজা খুলে লিখতে চেয়েছি। যে উদ্যমতা তাড়িয়ে বেড়ায় সোনালী ফসল, নক্ষত্রের দ্যুতিময় গতি, আনন্দময় দীপ্তি তাইতো শোনাতে চেয়েছি মানুষকে। যারা অন্যায়ের সমুদ্রস্রোতে বিলীন হয়ে গেছে, যারা রাতের অন্ধকারে কোথাও হারিয়ে গেছে, যারা বিলুপ্ত হতে হতে এক লহমায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে, যারা ক্ষণে ক্ষণে মানুষের হৃদপিন্ডের কাছে আছড়ে পড়ে আমি তাদের কথা লিখতে চেয়েছি। যারা বেদনায় জর্জর, মানুষের প্রতি যাদের অক্ষয় মমত্ববোধ, যারা আত্মার আত্মীয় তাদেরকে আমি আনন্দ ও শক্তি বিতরণ করতে চেয়েছি। যারা আপন আকাশ দেখতে পারে না, যারা পাপের অনুশোচনায় নত তাদেরকে অদৃশ্য জগতের সৌন্দর্য দেখাতে চেয়েছি। প্রেমের অমূল্য সম্পদ দিয়ে সারা জগত জয় করা যায়-এই অমোঘ বাণী মানুষের কাছে পৌছে দিতে চেয়েছি।
আমি আত্মার উপকরণ যোগাতে নিজেকে সাহিত্যের কাছে, সত্যর কাছে বন্ধক রেখেছি, আমি কেবল আত্মার ঐশ্বর্য ভিক্ষা করেছি।

আত্ম বিলুপ্তির আত্মঘাতী পথে নিজেকে ঠেলে দেওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই।
আমার আত্মজ্ঞান, আত্মানুসন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসা বা আধ্যাত্মিক চেতনা আত্মঅহংকে প্রশ্রয় দেয়ার কোনো অনুমোদন দেয় না। কফিনে অবস্থান করার পূর্ব পর্যন্ত আমার আত্মায় সাহিত্যের ঐশ্বরিক নীল শিখা অনবরত জ্বলতে থাকুক। মৃত্যুর আচ্ছাদনের নিচে ভূগর্ভস্থ অন্ধকারে আমার দেহ ঢাকা পড়ে যাক কিন্তু সাহিত্য নয়।

লেখক: গীতিকবি
faraizees@gmail.com